বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা ও ১৩ পুলিশকে হত্যার ঘটনায় থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল মালেক বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এই হামলায় এনায়েতপুর থানায় চার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল। এর আগে গত ২৫ আগস্ট রাতে এসআই আব্দুল মালেক বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ছয় হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছেন।
মামলায় এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুল্লুক চাঁদ, বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহুরুল ভূঁইয়ার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫ থেকে ৬ হাজার জনকে আসামি করে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চুর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবৈধ দাবিদাওয়া মেনে না নেয়ায় এনায়েতপুর থানা পুলিশের ওপর তার ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারকৃত এক আসামিকে তার দাবিমতো ছেড়ে না দেয়ায় এবং ওই আসামির বিরুদ্ধে মামলা নেয়ায় তার নেতৃত্বে ৪৫০ থেকে ৫০০ জন অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারী অত্র থানা ঘেরাও করে। এ সময় তারা থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুর রাজ্জাককে অপসারণের দাবি জানায়। দাবি মেনে না নেয়ায় আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু এনায়েতপুর থানা পুলিশের অপূরণীয় ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজতে থাকে।
এ অবস্থায় গত ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা এনায়েতপুর থানার সামনে সমবেত হয়। এ সময় থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাক হ্যান্ড মাইক দ্বারা সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘এই থানা আপনাদের সাধারণ জনগণের। আপনারা থানার কোনো ক্ষয়ক্ষতি করবেন না।’
এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষায় টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে হামলাকারীরা পুলিশের কোয়ার্টার ও অফিসার ইনচার্জের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দেখে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চুর নেতৃত্বে আসামিরা থানা কম্পাউন্ডে এসআই তহছেনুজ্জামান, এএসআই ওবায়দুর রহমান, কনস্টেবল আরিফুল আজম, রবিউল আলম শাহ, হাফিজুল ইসলাম, শাহিন ও রিয়াজুল ইসলামকে পিটিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
এক পর্যায়ে আসামিরা থানা ভবন ধ্বংস ও জীবিত পুলিশ সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে থানা ভবনেরএভতর প্রবেশ করে ইস্যুকৃত অস্ত্র, গুলি এবং জনসাধারণের জমাকৃত বেসরকারি অস্ত্র ও গুলি লুট করে। লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গুলি এবং সঙ্গে থাকা বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা আসামিরা থানার ভেতরে ও বাইরে থাকা অফিসার ও ফোর্সকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
এ সময় থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাক, এসআই আনিছুর রহমান, এসআই রহিজ উদ্দিন খান, এসআই প্রণবেশ কুমার বিশ্বাস, কনস্টেবল আব্দুল সালেক, কনস্টেবল হানিফ আলী থানার পাশে বাবু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নিলে আসামিরা সেখানে গিয়ে তাদেরকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
অন্য পুলিশ সদস্যরা আত্মরক্ষায় পার্শ্ববর্তী বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এ সয়ম নারী কনস্টেবল রেহেনা পারভীনকে মারধর করে টানাহেঁচড়া করে শ্লীলতাহানি করে।
পরবর্তীতে বিকেলে সেনাবাহিনীর একটি দল থানা এলাকায় পৌঁছে নিহত পুলিশ সদস্যদের মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়- আসামিরা পাঁচটি তড়াশ পিস্তল ও আটটি ম্যাগাজিন, একটি চায়না পিস্তল ও দুটি ম্যাগাজিন, চারটি চায়না রাইফেল ও ৩৭টি চার্জার, দুটি চায়না রাইফেল টাইপ ও দুটি ম্যাগাজিন, ছয়টি ১২ বোর শটগান, একটি ৩৮ মি.মি গ্যাস গান লঞ্চার, ৭.৬২/৩৯ মি.মি গুলি ১৬৮ রাউন্ড, ৭.৬২/২৫ মি.মি গুলি ১৬ রাউন্ড, ৯/১৯ মি.মি গুলি ৬০ রাউন্ড, ১২ বোর শটগান (রাবার কার্তুজ) ২২৭ রাউন্ড, ১২ বোর শটগান (লেটবল কার্তুজ) ৩৫৯ রাউন্ড, লংরেঞ্জ গ্যাস শেল ৩৮ রাউন্ড, শর্ট রেঞ্জ গ্যাস শেল ৩৬ রাউন্ড লুট করে নিয়ে যায়।
আসামিরা এছাড়াও একটি ডাবল কেবিন ও একটি সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ, পুলিশ সদস্যদের ১৫টি মোটরসাইকেল ও একটি ট্রাক, বিভিন্ন সময় আটককৃত নতুন-পুরনো ১২টি মোটরসাইকেল, থানার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রেজিস্টার ও নথিপত্র, আসবাবপত্র, কম্পিউটার, ওয়াকিটকি বিভিন্ন ডকুমেন্ট আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এতে এনায়েতপুর থানায় চার কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: