আড়িয়াল খাঁ নদীর উপরে একটি ব্রীজ চেয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছেন বরিশালের তিনটি উপজেলার লাখো মানুষ। গত পনের বছরে পনের বার তারা শুধু প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন ঘটেনি তাদের এই স্বপ্নের। এখানে চলমান মীরগঞ্জ ফেরীঘাটে রীতিমতো অনিয়ম আর ঘাট ইজারাদারের স্বেচ্ছাচারিতায় অতিষ্ঠ দুই উপজেলার লাখো মানুষ।
উপচে পরা ভিড়ে মোটরসাইকেল ও যানবাহন নিয়ে ট্রলারগুলোর পারাপার কতটা ঝুকিপূর্ণ তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ খেয়াঘাটে। ওপারে মুলাদি উপজেলার কাজীরচরে পৌঁছাতে পৌনে একঘন্টা প্রয়োজন ট্রলারে। বলা যায়, বরিশালের সবচেয়ে অবহেলিত জনপদ হিসেবে মুলাদি, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার নাম এখন সর্বজন স্বীকৃত। শুধু বংশ পরম্পরায় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের খুনখারাবি বা মারামারির জন্যই নয়, নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের হাহাকারের জন্যেও এ অঞ্চল এখন সমান প্রসিদ্ধ।
মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, স্কুল ছাড়াও অসংখ্য বসতভিটা, ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে এ অঞ্চলে আড়িয়াল খাঁ ও মেঘনা নদীর ভাঙনে। এরমধ্যে সবচেয়ে করুন ও মানবিক জীবনযাপন মেহেন্দিগঞ্জের মানুষের। চারদিকে যাদের অথই জলের পাহারা। শহরের সাথে যোগাযোগ শুধু স্প্রীডবোট বা নৌকা। আর রাত নামলেই গৃহবন্দী জীবন।
এরপরই মুলাদি ও হিজলা উপজেলার অবস্থান। এ দুটি উপজেলা পাশাপাশি এবং একই সড়কে হলেও সমস্যা তাদের একইরকম। এখানে আড়িয়াল খাঁ এবং মেঘনা নদী শহরের সাথে এই দুই উপজেলাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। রাত হলে তাই তাদেরও গৃহবন্দী জীবন এখানে। রাতে প্রসব বেদনা উঠে সকালের অপেক্ষা করে প্রাণত্যাগ করেছেন এ অঞ্চলের শত শত মা-বোন। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে সুচিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে আজো মারা যাচ্ছেন অনেকে।
হিজলা এবং মেহেন্দিগঞ্জ নিয়ে বরিশাল ৪ আসনটি গঠিত। ফলে হিজলার সাথে মেহেন্দিগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নদী ভাঙন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই হিজলার তিনপাশে এবং মুলাদির একপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন এ অঞ্চলের দলমত নির্বিশেষে প্রতিজন বাসিন্দা। বাবুগঞ্জ ও মুলাদি উপজেলা বরিশাল ৩ সংসদীয় আসন। এখানের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু যদিও ব্রীজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তবে তা কখনো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেননি। কেননা বরিশাল ২ উজিরপুর বানারিপাড়ার সাবেক সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননকে ডিঙ্গিয়ে বাবুগঞ্জেই কিছু করা প্রায় অসম্ভব। কেননা তার নিজ বাড়ি এখানের এই বাবুগঞ্জে। তিনি ইতিপূর্বেও এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন তবে নিজ এলাকার উন্নয়নে কখনো কোনো ভূমিকা নেননি বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
সেখানে মুলাদির মানুষের জন্য কিছু করা হবে বলে কখনোই বিশ্বাস করতে চাননি মুলাদিবাসী। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। দীর্ঘ পনের বছরের আওয়ামী শাসনামলে চরম অবহেলিত থেকে গেছে মুলাদি, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা। এটি মুলত জেলে অধ্যুষিত অঞ্চল। নদীতে মাছ ধরে ও কৃষিকাজ করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবীকা। তিন উপজেলার লোকসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ হবে বলে অনুমান করেন মেহেন্দিগঞ্জের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এ,কে,এম মাহফুজ উল আলম। সরকার পতনের আগে ও পরে একই কথা বললেন তিনি। বলেন, শুধু মেহেন্দিগঞ্জের জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ। ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে আমরা যে এখনো বেঁচে আছি এটাই সপ্তাশ্চর্য। আগামী ১০ বছরও যদি উন্নয়ন বরাদ্দ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয়, তবুও এই অঞ্চলের সমস্যার সমাধান হবে না। পরিকল্পিত নদী রক্ষা বাঁধ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সবার আগে প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
মেহেন্দিগঞ্জের যোগাযোগ সবটাই নদী পথ হলেও হিজলা উপজেলায় সড়ক পথও রয়েছে। নদী পথে বরিশাল থেকে সরাসরি স্পিডবোটে তিন উপজেলাতেই আসাযাওয়া সম্ভব হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে জানালেন হাতেম আলী কলেজে অধ্যায়নর হিজলার বাজার টেক এলাকার বাসিন্দা রেদোয়ান। তিনি বলেন, গরীব, মধ্যবিত্ত কিম্বা ধনী, আমাদের সবাইকে বাজার-সদায় করতে, চাকরি, পড়াশুনা করতে বরিশাল শহরে যেতেই হয়। শহরে যেতে হলে হিজলা থেকে মহেন্দ্র বা অটোরিকশা নিয়ে মুলাদির কাজীচর খেয়াঘাট যেতে হবে। সেখান থেকে খেয়া পার হয়ে ওপারে মীরগঞ্জ। মীরগঞ্জ থেকে অটোরিকশা বা ইজিবাইক নিয়ে বাবুগঞ্জের রহমতপুর যেতে হবে। আগে তাও লাকুটিয়া দিয়ে যাতায়াত করা যেত। কিন্তু ঐ সড়ক এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পরে আছে। আমাদের তাই আরো ঘুরে রহমতপুর থেকে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় পৌঁছাতে কম হলেও দুই আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে এখন।
তিনপাশে নদী, একপাশে সড়ক চলে গেছে মুলাদির কাজীরচর খেয়াঘাট পর্যন্ত। চারিদিকে ভাঙনের চিত্র এখানে। বেড়িবাঁধ এলাকায় বাঁধের উপরই অসংখ্য ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। টেকের বাজার বা বাজার টেক পার হয়ে দক্ষিণে বড়জালিয়া ইউনিয়নের বাউসিয়া গ্রাম। মেঘনা নদীর পাড়ে এখানে ২০০ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে নদী ভাঙন রোধের চেষ্টা ছিলো, যা আপাতত বন্ধ আছে। বাউসিয়া গ্রামবাসী বলেন, ভাঙনের তীব্রতা এতোটাই যে ছয়টি গ্রাম ইতিমধ্যেই বিলিন হয়ে গেছে। সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এসে এই জিও ব্যাগ যদি না ফেলতেন তবে এবছরের মধ্যে হিজলা উপজেলা পরিষদ এলাকাও নদীতে বিলুপ্ত হয়ে যেত বলে জানান তারা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ঝন্টু হাওলাদার সহ কয়েকজন গ্রামবাসী আরো বলেন, এই জিও ব্যাগ হয়তো সাময়িক ভাবে ভাঙন রোধে সাহায্য করবে, তবে নদীর দুই পাড়ে বরিশালের চরকাউয়া ও চরবাড়িয়া বেড়িবাঁধের মতোই বাঁধ নির্মাণের দাবী করেন তারা। একইসাথে মীরগঞ্জ ব্রীজ নির্মাণের যে প্রতিশ্রুতি ছিলো বর্তমান বৈষম্য বিরোধী সরকারের কাছে সেটি রক্ষার দাবী জানান হিজলা উপজেলার সাধারণ মানুষ।
এখানে উপজেলা পরিষদ চত্বরে কথা হয় স্থানীয় সাংবাদিক ও হিজলা প্রেসক্লাবের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন এর সাথে। তিনি জানালেন, ইতিমধ্যেই ৫টি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকির মুখে রয়েছে আরো অর্ধশত গ্রাম। পানি উন্নয়ন বোর্ড যদিও এখানে ৬২৮ কোটি টাকার কাজের বরাদ্দ দিয়েছেন। তবে ১০টি প্যাকেজে এই কাজ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত একটি প্যাকেজের কাজই দৃশ্যমান বলে জানান সাংবাদিক দেলোয়ার।
এ বিষয়ে হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নদী ভাঙন রোধে গৃহিত পদক্ষেপ আমার আসার পূর্বে হয়েছে। এ বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। তবে কাজ চলমান রয়েছে। কাজের মান নিয়েও কিছু বলতে পারবোনা। তবে মীরগঞ্জ সেতু নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে সার্ভেয়ার টিম ঘুরে গেছেন। হয়তো এখন টেন্ডার কার্যক্রম প্রক্রিয়া চলছে। মীরগঞ্জ সেতু তৈরি সম্পন্ন হলে এ অঞ্চলের মানুষের ৮০ ভাগ ভোগান্তি দূর হয়ে যাবে। একইসাথে মীরগঞ্জ ফেরী ও ঘাটের ইজারাদারদের বিরুদ্ধে অনিয়ম নিয়ে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাকিলা রহমানের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাকিলা রহমান জানালেন, সেতুর বিষয়ে তার কাছে কোনো আপডেট তথ্য নেই, তবে ফেরীঘাটের অনিয়ম অভিযোগ তার কানেও এসেছে এবং এ নিয়ে দুই সপ্তাহ আগেই মোবাইল কোট পরিচালনা করেছেন। আবারও করবেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য এই মুহূর্তে উপজেলা প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন নির্বাহী কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন: