পারিবারিক বিরোধের জেরে সৎ ছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মা স্বপ্না বেগম (২৮)। পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে পেরে স্বপ্নাসহ পরিকল্পনায় জড়িত বাবাকেও হত্যা করে আত্মহত্যার গল্প সাজান ছেলে হিমেল। সঙ্গে হত্যা করেন ৪ বছরের ছোট বোন জান্নাতুলকে।
গত সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ বৃহস্পতিবার দুপরে আশুলিয়ার একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন পিবিআই’র ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা।
গত ৪ অক্টোবর ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার বারুয়াখালী এলাকা থেকে তরিকুল ইসলাম তারেক ওরফে হৃদয় (২৮) ও গত ২৪ অক্টোবর আশুলিয়ার জিরাবো এলাকা থেকে অপর আসামি তানভীর হাসান হিমেলকে (২২) গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার তানভীর হাসান হিমেল নিহত বাচ্চু মিয়ার প্রথম স্ত্রীর ছেলে। আর তরিকুল ইসলাম তারেককে আসামি হিমেলকে হত্যার জন্য ভাড়া করেছিলেন তার বাবা নিহত মিজানুর রহমান বাচ্চু।
পিবিআই জানায়, আশুলিয়ার উত্তর ভাদাইল এলাকার চার তলা ভবনের চতুর্থ তলায় নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকতেন মিজানুর রহমান বাচ্চু (৫৩), তার চতুর্থ স্ত্রী স্বপ্না বেগম (২৮) ও মেয়ে জান্নাতুল (৪) ও প্রথম স্ত্রীর সন্তান তানভীর হাসান হিমেল।
প্রথম স্ত্রীর সন্তান হিমেলের সঙ্গে পারিবারিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েন স্বপ্না বেগম। হিমেলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন স্বামী-স্ত্রী মিলে। পরিকল্পনামতো ছেলে হিমেলকে হত্যার জন্য তরিকুল ইসলাম তারেক ওরফে হৃদয়কে ভাড়া করেন বাবা মিজানুর রহমান বাচ্চু। পরে নিজের ফ্ল্যাটের সঙ্গে সংযুক্ত একটি কক্ষে থাকতে দেন এবং নিজেদের সঙ্গেই খাবারের ব্যবস্থা করেন।
পিবিআই আরও জানায়, ঘটনার ১০/১২ দিন আগে ছেলে হিমেলকে হত্যার পরিকল্পনার ব্যাপারে আলোচনা করেন বাচ্চু। এ সময় বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে বাসায় ফিরলে তাদের পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে পারেন হিমেল। নিজেকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে পরে তরিকুলের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে সমস্ত কথা স্বীকার করেন তরিকুল। পরে হিমেলের কাছে কান্নাকাটি করে তরিকুল ক্ষমা চান। এরপর হিমেল নিজেই তরিকুলকে নিয়ে বাবা ও সৎ মাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১২ সেপ্টেম্বর বাবা ও সৎ মা এবং ৪ বছরের সৎ বোনকে হত্যা করে কক্ষ থেকে স্বর্ণালংকার লুট করে আত্মহত্যার নাটক সাজান তারা।
ঘটনার পর স্বপ্না বেগমের বোন মোছা. লাবন্য আক্তার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করলে মামলাটির তদন্তভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরে ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে হিমেল ও তারেককে গ্রেপ্তার করা হয়।
যেভাবে বাবা, সৎ মা ও বোনকে হত্যা করেন হিমেল
গত ১২ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টার দিকে স্বপ্না বেগম মেয়ে জান্নাতুলকে নিয়ে স্কুলে চলে যান। এ সময় মিজানুর রহমান বাচ্চু তার কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন। সকাল পৌনে ৯টার দিকে আসামি তরিকুল ইসলাম তারেক ওরফে হৃদয় ও তানভীর হাসান হিমেল বাচ্চুর শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। হিমেল তার হাতে থাকা হাতুড়ি দিয়ে বাচ্চুর মাথায় পরপর দুটি আঘাত করেন এবং আসামি তারেক ভিকটিম বাচ্চুর পা চেপে ধরে রাখেন। পরে আসামি তারেক বালিশ চাপা দিয়ে বাচ্চুর মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ খাটের উপরে কাথা দিয়ে ঢেকে রাখেন।
এরপর তারা স্বপ্না বেগম এবং জান্নাতুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। সকাল ১০টা ১০ মিনিটে স্বপ্না বেগম মেয়ে জান্নাতুলকে নিয়ে বাসায় এসে কলিং বেল চাপ দিলে হিমেল ভেতর থেকে দরজা খুলে দেন। ভিকটিম স্বপ্না বেগম শয়নকক্ষে প্রবেশ করে বাচ্চুকে ডাক দেন। তখন আসামি তারেক পেছন থেকে স্বপ্না বেগমের গলা চেপে ধরে বিছানার ওপরে ফেলে বালিশ চাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেন। এ সময় জান্নাতুল চিৎকার করে উঠলে হিমেল তাকে মেঝেতে ফেলে মুখ চেপে ধরেন এবং পাশে থাকা খেলনা পুতুল দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।
পরে আলমারিতে থাকা স্বর্ণালংকার লুট করে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে রুমের ভেতরে কেরোসিন তেল দিয়ে আগুন লাগিয়ে কাঁচি দিয়ে ইস্পাত শিটের দরজা ছিদ্র করে বাইরে থেকে দরজার ভেতরের হ্যাজভোল্ট লাগিয়ে দেন হিমেল ও তারেক। কিছুক্ষণ পরে আগুনের ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তারা আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করেন। তাদের চিৎকার শুনে এবং আগুনের ধোঁয়া দেখে বাসার অন্যান্য ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় লোকজন তাদের সহায়তায় রুমের দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে আগুন নেভান এবং মিজানুর রহমান বাচ্চু, স্বপ্না বেগম ও জান্নাতুলের মরদেহ উদ্ধার করেন। হত্যার পরে আসামিরা এই হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেন।
পিবিআই পুলিশ সুপার কুদরত-ই-খুদা জানান, মামলাটির তদন্ত শেষে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হাতুড়ি, পুতুল ও কাঁচি উদ্ধার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: