
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউপির আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই বারের চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলাম। ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলের প্রভাব বিস্তার করে অল্প সময়ের ব্যবধানে ছিচকে চোর থেকে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, প্রভাব-খাটিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।
তার সেই সাম্রাজ্য এখন দখলে নিয়েছে প্রতিপক্ষরা। কিশোর বয়সেই নিষিদ্ধ চরমপন্থি দলের সঙ্গে দরিদ্র নবীদুলের সখ্যতা গড়ে উঠে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আহ্বানে অন্ধকার জগৎ ছেড়ে তার পুরো বাহিনী নিয়ে নবীদুলও ভালো হওয়ার পণ করে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে সয়দাবাদ ইউপির চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা বেলাল হোসেন খুন হন। নবীদুল ছিলেন ওই খুনের মামলার প্রধান আসামি।
সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে সকল আসামি ওই মামলা থেকে খালাস পান। পরে ২০০৪ সালে বিএনপি সমর্থক নবীদুল যোগ দেন আওয়ামী লীগে। পদ পান ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের। সেই সঙ্গে চালিয়ে যেতেন ছিচকে চুরি ও ছোটখাটো অপরাধ।'
এলাকাবাসী জানান, ২০০৭ সাল পর্যন্ত সে বাসে হেলপারি করেছে। ভেতরে ভেতরে নিজের অবস্থান শক্ত করতে থাকেন নবীদুল। ২০১০ সালে সয়দাবাদের মূলিবাড়িতে খালেদা জিয়ার জনসভাস্থলে ট্রেন পোড়ানোর ঘটনার পর নবীদুলের ভাগ্য খুলতে থাকে। এ ঘটনাকে পুঁজি করে মামলা থেকে বাঁচাতে এবং মামলায় ফাঁসাতে বিএনপি সমর্থিত কারিগর ও প্রামানিক সম্প্রদায়ের তালিকা করে বিশাল অর্থ বাণিজ্য করেছেন নবীদুল। বিশাল বাহিনী গঠন করে পুরো সয়দাবাদ এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, পূর্বমোহনপুর চর থেকে অবৈধভাবে বালু বিক্রির কমিশন নিতেন তিনি। এ ছাড়াও পঞ্চসোনা ও গাছাবাড়ির বালুমহলও চলতো তার ইশারায়। বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের জায়গায় মহাসড়কের মুলবাড়ির এলাকায় তার নেতৃত্বে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল ট্রাক লোড-আনলোড পয়েন্ট। এ ছাড়া আড়ালে চালাতেন মাদকের ব্যবসা। ২০১৫ সালে সদর থানা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক সাইফুল ইসলাম খুন হয়। সে মামলা থেকে বাঁচাতে বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের কাছ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন নবীদুল। একই বছরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান তিনি।
এ অবস্থায় ২০১৬ সালে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নবীদুল। ২০১৮ সালে আবারো সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না ও জেলা 'আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসানের আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। এসব পদ-পদবি ও প্রভাব খাটিয়ে নবীদুল ২০টি ট্রাক কিনেছিলেন। প্রায় ৪০ লাখ টাকায় কেনা মাইক্রোবাসে ঘোরাফেরা করতেন।
বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের শ্রমিক নিয়োগ, প্রতিষ্ঠানটির পুরাতন মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের টেন্ডার, শিল্পপার্ক ও ইকোনমিক জোনে মাটি ভরাটসহ এলাকার সকল ঠিকাদারি কাজই ছিল তারই নিয়ন্ত্রণে। এলাকায় অন্য কেউ ব্যবসা করতে চাইলে নবীদুলকে কমিশন দিতে হতো, নয়তো অংশীদার বানাতে হতো। মহাসড়কের পাশে মূলিবাড়ি এলাকায় ক্রয়কৃত সাড়ে ৪ শতক জায়গায় নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল ৫ তলা ভবন। পৈত্রিক ভিটায় রয়েছে ২ তলা বিশিষ্ট আরেকটি ভবন। নিজ গ্রাম মুলিবাড়ি, পূর্ব মোহনপুর, পঞ্চসোনা, জগতলা এলাকায় বেশ কিছু কৃষি-অকৃষি জমি থাকার কথা জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
২০২০ সালে তার অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে অনুসন্ধানে দুদকও সেই সময় তৎপর হয়। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান নবীদুল। দলের ভেতরে বাইরে ব্যাপক সমালোচনা থাকার পরও ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় আবারো চেয়ারম্যান হন। শোনা যায় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণেই মনোনয়ন বাগিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
নবীদুল তার এলাকায় কোনো বিরোধীমত সহ্য করতে পারতেন না। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিএনপি নেতা-কর্মীকে মারধর এবং হত্যার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, নিজ দলে তার মতের বিরোধীদের ওপরও চলতো অমানসিক নির্যাতন। যুবদল নেতা আকবর আলীকে গুলি করে হত্যা, বিএনপি নেতা শহীদকে মারধর, আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মজনু ও মৎস্যজীবী লীগ নেতা মোয়াজ্জেমের ওপর একাধিকবার হামলা ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।'
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর নবীদুল আত্মগোপনে চলে যান। তার দুইটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। লুট করা হয়েছে খামারের গরু। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যবসা বাণিজ্যসহ সকল কিছু এখন বিএনপির নেতা-কর্মী ও প্রতিপক্ষরা দখলে নিয়েছেন।
৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সিরাজগঞ্জ শহরে যুবদল ও ছাত্রদলের তিন নেতা-কর্মী নিহতের মামলায় সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নবীদুলকেও আসামি করা হয়েছে। সবাই এখন আত্মগোপনে রয়েছেন।
আরও পড়ুন: