রবিবার

২০ এপ্রিল, ২০২৫
৬ বৈশাখ, ১৪৩২
২২ শাওয়াল, ১৪৪৬

বন কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে শিল্পপতির ভূমি দখলের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ ২০:৩৬

শেয়ার

বন কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে শিল্পপতির ভূমি দখলের অভিযোগ
নাজমুল ইসলামের জমিতে অবৈধভাবে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ করা হয়। ছবি: নাজমুল ইসলামের সৌজন্যে

হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে প্রায় পাঁচ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি জোরপূর্বক দখলের অভিযোগ উঠেছে ময়মনসিংহের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভূমি দখলের এই পথ তৈরি করে দিয়েছেন বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম- এমন অভিযোগ করেন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলাম। নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, ভূমি দখলের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার বিনিময়ে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন আশরাফুল আলম।

এ ছাড়া, নাজমুল ইসলাম জানান, ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত ওই জমি দখল করতে যেয়ে ধারাবাহিকভাবে সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়েছেন আশারফুল আলম। অপহরণ, হামলা, শারীরীকভাবে লাঞ্ছিতসহ আশরাফুল আলমের ইন্ধনে এমন অসংখ্য অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন জমির মালিক ভুক্তভোগী নাজমুল।

সংঘবদ্ধ ভুমিদস্যু এবং চাঁদাবাজ চক্রের খপ্পরে পড়ে সম্প্রতি সেনাবাহিনী ও পুলিশ বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেন প্রবাসী শিল্পপতি নাজমুল ইসলাম।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ১৮ বছর আগে ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের আমতলী এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপনের উদ্দেশ্যে ৩৫ বিঘা নিষ্কন্টক ও দেয়াল দিয়ে ঘেরা জমি ক্রয় করেন নাজমুল। জমি কেনার পর নিয়মানুযায়ী নামজারী ও খাজনা পরিশোধ করার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দিয়ে জমি দেখাশোনা করে আসছিলেন তিনি।

স্থানীয় বনবিভাগ ওই জমির ১৫৪ নং দাগে তাদের জমি রয়েছে বলে দাবি করলে ২০০৬ সালে নাজমুল ইসলাম ভালুকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে এ বিষয়ে মামলা করেন। পরে তৎকালীন এসিল্যান্ড নিজেদের সার্ভেয়ার দিয়ে জরিপ ও স্কেচম্যাপ তৈরি করে ওই জমি বনের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা বনবিজ্ঞপ্তিতে ভুমি থেকে অবমুক্ত করতে সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রতিবেদন ময়মনসিংহ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ফরেস্ট সেটলমেন্ট অফিসার বরাবরে পাঠান। 

পরে, সেই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ফরেস্ট সেটলমেন্ট অফিসার নিজে সরেজমিনে তদন্ত করেন। রায়ে তিনি উক্ত জমি বনের দাবি থেকে অবমুক্তি করেন এবং ২০ ধারায় চূড়ান্তভাবে সংরক্ষিত বন ঘোষণার বহির্ভুত রাখার জন্য আদেশ দেন।

এরপর ২০০৭ সালে বনবিভাগ পুনরায় ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার আদালতে আপিল করে। শিল্পপতি নাজমুলের জমির সকল কাগজ পর্যালোচনা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ফরেস্ট সেটলমেন্ট অফিসারের রায়ের কপি ও এসিল্যান্ড কার্যালয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার আদালত ওই জমি বনের বহির্ভুত রাখার আদেশ বহাল রাখেন এবং বনের পক্ষ থেকে করা আপিল আবেদন খারিজ করে দেন।

অভিযোগ আছে, এর দীর্ঘদিন পর ২০১৭ সালে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করে না পেয়ে আদালতের সকল রায় ও আদেশ অগ্রাহ্য করে জমির প্রকৃত মালিক ওই শিল্পপতিকে নানাভাবে হয়রানি শুরু করেন স্থানীয় বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম। পরে বাধ্য হয়ে নাজলুম ইসলাম ২০১৮ সালে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। শুনানীর পর মহামান্য হাইকোর্ট যতদিন পর্যন্ত এই জমি সংক্রান্ত অভিযোগের নিষ্পত্তি না হবে, ততদিন পর্যন্ত ওই জমিতে নাজমুল ইসলামের পক্ষে স্ট্যাটাস কো এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

পরবর্তীতে দীর্ঘদিন কোনো ঝামেলা ছাড়াই নিজ জমি তত্ত্বাবধায়ক দিয়ে দেখভাল এবং ভোগদখল করে আসছিলেন তিনি। তথ্যানুযায়ী, নাজমুল ইসলাম স্বপরিবারে বিদেশে পাডি দিয়েছেন বলে ২০২২ সালে জানাজানি হবার পর স্থানীয় ভুমিদস্যু ও চাঁদাবাজ চক্রের হোতা আবু জাফর সরকার ও আওয়ামী সন্ত্রাসী গংদের সঙ্গে নিয়ে জবরদখলের উদ্দেশ্যে আবির্ভুত হয় বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম।

নাজমুল ইসলাম বলেন, ২০২৩ সালে সাজানো হয় বনের জমি উদ্ধারের নাটক। তার দেশের বাইরে থাকার সুযোগে হাইকোর্টের ২০১৮ সালের নির্দেশ অমান্য করে গত পাঁচ আগষ্ট ২০২৩ তারিখে দিনব্যাপী হবিরবাড়ী বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম খানের নেতৃত্বে ওই জমি উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করা হয়। এমনকি সেই ঘটনায় শিল্পপতি নাজমুলকে ভূমিদস্যু হিসেবে দেখিয়ে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। দেশের বাইরে অবস্থান করায় ওই ঘটনার বিষয়ে কোনো কিছুই তখন জানতে পারেননি নাজমুল ইসলাম।

নাজমুল ইসলাম অভিযোগ করে বাংলা এডিশনকে বলেন, বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম, হবিরবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান বাচ্চু, হারুনুর রশীদ, স্থানীয় চাঁদাবাজ ও ভুমিদস্যু চক্রের হোতা আবু জাফর সরকার, তার ভাই আক্তার সরকার, ছেলে নাঈম সরকার (বিভিন্ন মামলায় জেলে রয়েছে), খোরশেদ আলম জীবন (মাদক মামলায় জেলে রয়েছে) ও ওমর আলী গংদের সহায়তা ও প্রত্যক্ষ মদদে ভূমি দখলের জন্য নানা অপরাধ সংগঠিত হয়। 

জমির মালিক নাজমুল ইসলামের নিয়োগকৃত তত্ত্বাবধায়ক যেন জমিতে যেতে না পারেন সেজন্য জমির সামনের সীমানা প্রাচীর ঘেষে এবং জমির ওপর হবিরবাড়ি অঞ্চলের সকল ময়লা আবর্জনা ও বর্জ্য স্তুপাকারে ফেলতে থাকে। এমনকি ওই গং পরপর ১১ বার নাজমুল ইসলামের জমির দেয়ালের গেটের তালা ভেঙে ফেলে ও দুইবার জমিতে স্থাপিত হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত লোহার সাইনবোর্ড ভেঙে নিয়ে যায়, এমন অভিযোগও করেন জমির মালিক।

নাজমুল ইসলামের জমির বাউন্ডারির দরজা ভেঙ্গে ফেলে দুবৃত্তরা

এখানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না ওই চক্র। অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, কমপক্ষে ছয়বার ওই জমির তত্ত্বাবধায়কদের মারধোর করে রক্তাক্ত করে তারা। গভীররাতে অস্ত্রের মুখে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করে ওই চক্র। ফলে বারবার তত্ত্বাবধায়ক বদলিয়েও কোনো সমাধান করতে পারেননি নাজমুল ইসলাম। 

একইসঙ্গে নাজমুল ইসলাম দাবি করেন, বনের কাঁধে ভর করে ওই জমি জবরদখলের জন্য বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম ও ভুমিদস্যুদের মাঝে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার বিনিময় চুক্তি হয়।

এরপর থেকেই আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে ওই জমি দখল করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে সম্মিলিত দস্যুচক্র। এ বিষয়ে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভালুকা মডেল থানায় ছয়বার অভিযোগ করলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রভাব এবং ওই চক্রের বাধায় আইনগত কোনো সহযোগিতা পাননি শিল্পপতি নাজমুল ইসলাম।

গত পাঁচ আগস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের পতনের পরও নতুন করে ওই জমি জবরদখলের জন্য বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম ও স্থানীয় ভুমিদস্যু গং নতুন করে নাটক শুরু করেন। কোনো কারণ ছাড়াই ওই জমির ময়লা সরানোর কাজ তদারকীর জন্য নাজমুল ইসলামের নিয়োগ করা তত্ত্বাবধায়কসহ তিনজনকে ১৮-ই নভেম্বর অপহরণ করে আশরাফুল গং।

এর তিন ঘণ্টা পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার কর্নেল মাহমুদ এবং সিও মেজর নোমানের হস্তক্ষেপের ফলে ও প্রশাসনের চাপের মুখে অপহৃতদের ফেরত দিতে বাধ্য হয় ভূমিদস্যুরা। পরে জমির মালিক নাজমুল ইসলাম সেনাবাহিনীর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার কাছে আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে অপহরণ ও চাদাবাজীর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

তবে বারবার আইনের দ্বারস্থ হলেও, কোনো সুষ্ঠু সমাধান পাননি শিল্পপতি নাজমুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এখনও ভূমিদস্যু চক্রের সদস্যরা তার বৈধ জমি হাতিয়ে নেয়ার নানা ফন্দি করছে। একইসঙ্গে আশরাফুল আলমের চক্রান্তে তার নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিকর ভুয়া সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে বলেও আক্ষেপ করেন নাজমুল।

বন বিভাগের অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মানববন্ধন

ভুক্তভোগী শিল্পপতি নাজমুল কুখ্যাত ভূমিদস্যু আবু জাফর সরকার এবং দূর্নীতিবাজ বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুলসহ এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত সবার দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনানুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।

banner close
banner close