রবিবার

২০ এপ্রিল, ২০২৫
৬ বৈশাখ, ১৪৩২
২২ শাওয়াল, ১৪৪৬

কিশোর রাফিকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসান ওসি: তার অপরাধ কি জানে না সাক্ষী

বলরাম দাশ অনুপম, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১৩:২৩

শেয়ার

কিশোর রাফিকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসান ওসি: তার অপরাধ কি জানে না সাক্ষী
ছবি: কোলাজ

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র কিশোর তাউসিফুল করিম রাফিকে একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তারের ঘটনায় দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, ভোররাতে ঘুমন্ত রাফিকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর তিন লাখ টাকা ঘুষ চাইলে তা দিতে অস্বীকার করায় তাকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়। পুলিশের এজাহার, স্বাক্ষীদের বক্তব্য এবং পরিবারের অভিযোগে উঠে আসা তথ্য একে অন্যের সঙ্গে মেলে না।

স্থানীয়রা বলেন, টেকনাফ মডেল থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশের কুখ্যাত পথেই হাঁটছেন। মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি করেছেন।

ঘুমন্ত ছেলেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ:

২৬ নভেম্বর ভোর রাত। টেকনাফ উপজেলার যুবলীগ নেতা রেজাউল করিমের বাড়িতে অভিযান চালায় টেকনাফ মডেল থানার ওসি গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল। পুলিশের দাবি, অভিযানের সময় রেজাউল করিম পালিয়ে যান। তখন তার সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে রাফিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

কিন্তু রাফির মা নাসিমা আক্তার বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি জানান, ভোর ৪টার দিকে পুলিশের একটি দল দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। দরজা খুলতেই তারা আমার স্বামীকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পরে তারা ঘরের ভেতর ঢুকে ঘুমন্ত রাফিকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু কোনো কারণ বলেনি।

তিনি আরও বলেন, আমার ছেলেকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর এক পুলিশ কর্মকর্তা ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। পুলিশ আমাদের জানায়, তারা পাশের বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছে। অথচ পরে শুনি, সেই অস্ত্র রাফির কাছে পাওয়া গেছে বলে দেখানো হয়েছে।

জোরপূর্বক সাক্ষী বানানো হয়েছে :

মামলার প্রধান সাক্ষী হ্নীলা এলাকার স্থানীয় মসজিদের খতিব ও ইমাম জামাল হোসেন। তিনি জানান, ফজরের নামাজ পড়ানোর জন্য মসজিদে যাচ্ছিলাম। পথে আমাকে থামিয়ে ওসি গিয়াস উদ্দিন পরিচয় দিয়ে একটি বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে সিঁড়ির পাশে একটি কালো রঙের জিনিস দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কিছু দেখেছি কি না। কিন্তু আমি কিছুই দেখিনি।

জামাল হোসেন আরও বলেন, পুলিশ আমাকে জোর করে একটি খালি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছে। আমি কোনো অপরাধমূলক কিছু দেখিনি। অথচ আমাকে সাক্ষী বানানো হয়েছে।

মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী প্রবাসী নুরুল আমিনের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার বলেন, ভোর রাতে নারী পুলিশ সদস্যরা আমার ঘরে ঢুকে আলমারি তল্লাশি করে। পরে বলে, তারা অস্ত্র পেয়েছে। কিন্তু পরদিন শুনি, সেই অস্ত্র আমার ঘর থেকে নয়, রাফির কাছ থেকে উদ্ধার দেখানো হয়েছে।

পুলিশের দাবি:

টেকনাফ মডেল থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন বলেন, রাফির বাবা রেজাউল করিম একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং মাদক কারবারি। আমরা তার বাসায় অভিযান চালাই। অভিযানকালে রাফির কাছ থেকে একটি নীল রঙের ব্যাগে বিদেশি পিস্তল, ৬ রাউন্ড গুলি এবং ৪০ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য এই অস্ত্র মজুদ রাখা হয়েছিল।

তবে পুলিশের বিবৃতি এবং এজাহারের মধ্যে অসংগতি রয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, রাফির ডান হাতে থাকা ব্যাগ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অথচ সাক্ষীরা বলছেন, সেই অস্ত্র পাশের বাড়ির আলমারি থেকে উদ্ধার দেখানো হয়েছে।

মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিক্রিয়া ;

জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর জেলা কমিটির সভাপতি সুবিমল পাল পান্না বলেন, একটি শিশুকে এভাবে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়। এটি শিশু সুরক্ষা আইন লঙ্ঘনের বড় উদাহরণ। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত।

জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বলেন,এই ঘটনায় ওসির বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা  তদন্ত করছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে বুধবার টেকনাফের ১৪ বছর বয়সী  কিশোরকে রাফিকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

সকালে বিষয়টি নজরে আনার পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছেন।

৯ দিন কারাবাসের পর অবশেষে জামিন পেল সেই স্কুল ছাত্র রাফি:

বাবাকে না পেয়ে কিশোর ছেলেকে অস্ত্র দিয়ে আটকের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার ১৫ বছর বয়সী স্কুল  শিক্ষার্থী তাউসিফুল করিম রাফি (১৫) জামিন পেয়েছে।

কথিত এ ঘটনায় কারাগারে যাওয়ার ৯ দিন পর আজ বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজার  নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের বিচারক জিল্লুর রহমান তার জামিন মঞ্জুর করেন।

রাফির বাবা রেজাউল করিম বলেন, গতকাল জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাদের ডাকেন। বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজার  নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের বিচারক জিল্লুর রহমান মহোদয় জামিন মঞ্জুর করেন। আমরা এখনো আতঙ্কে আছি। জানি না আমার ছোট্ট ছেলেটা এই ট্রমা থেকে কখন বের হতে পারবে।

রাফির আইনজীবী আয়াসুল রহমান বলেন, রাফি শিশু হওয়ায় আদালত জামিন দিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রাফি কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন।

banner close
banner close