
খোলা আকাশের নিচেই তাবুতে বসবাস করছেন বেঁদে সম্প্রদায়ের মানুষেরা। দুমুঠো খাবারের জন্য পথে প্রান্তরে কিংবা নদীর তীরে ছোট তাবু বা টংঘরে চলে এই সম্প্রদায়ের জীবন।
দেশের সকল পেশায় আধুনিকতার ছোঁয়ায় জীবন মানের উন্নয়ন হলেও অনন্য এক জীবন যুদ্ধ করছেন বেঁদে সম্প্রদায়ের মানুষেরা।
এখানে বেঁদে সম্প্রদায় শ্রেণির মানুষের জীবন যুদ্ধ যেনো এক বিভিষিকাময়। তারা কি খেয়ে বাঁচে এবং কিভাবে জীবন যাপন করে বা তাদের কেউ মৃত্যু বরণ করলে শেষ পরিনতি দাফনটাও কিভাবে হচ্ছে এমন খবর রাখার যেনো কেউ নেই। এমনটাই জানাগেছে বেদে বহরে থাকা মানুষের কাছে।
বেদে সম্প্রদায়ের জীবন ব্যবস্থা এবং তাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গল্প-উপন্যাস, নির্মিত হয়েছে নাটক ও সিনেমা। কিন্তু তার পরও কষ্টের মধ্যে দিন পার করছে দেশের একমাত্র যাযাবর শ্রেণিভুক্ত মানুষ বেদে সম্প্রদায়।
তেমনি এক বেঁদে সর্দার ফরিদ মিয়া, ফরিদ মিয়ার আদিবাস ঢাকার সাভারের মাংতা পাড়া হলেও জীবিকার তাগিদে বছরের ১১ মাস ধরেই থাকে যাযাবর হিসেবে দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদ কিংবা নদীর তীরে।
তাদের জীবিকার অন্বেষনে তারা পরিবারের সদস্যগনকে নিয়ে বছরের পুরো এগারো মাস গাওয়ালে থাকেন। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সমানে সমান কাজ করেন জীবিকার তাগিদে। কেউ বাঁনর খেলা দেখিয়ে আনন্দ দিয়ে সামান্য টাকা আয় করেন, কেউবা শিংগা লাগান, কেউ আবার গাছ-গাছালীর টুকরো ঔষধ বিক্রি করেন। কেউ আবার সাপের খেলা দেখিয়ে চালাচ্ছেন জীবিকা।
এমন উক্তি প্রকাশ করে ভোলার একমাত্র প্রবেশদ্বার ইলিশা ঘাটে ৬টি পরিবারের বহর নিয়ে অস্থায়ী আবাসন টংঘর তৈরি করে থাকা বেঁদে ফরিদ। তিনি বলেন আমরা আজ ৮ দিন যাবৎ এখানে আছি। আরো কদিন থাকবো
মাংতা, মনটং বা বেঁদে সম্প্রদায়ের লোকেরা নদীতে নৌকায় বা নদীর তীরে ছোট ছোট ঝুপড়ি তৈরি করে বাস করে। তবে তাদের মনটং, মাংতা বা বেঁদে সম্প্রদায় বলেই আখ্যায়িত করে।
ইলিশার এ বহরে থাকা আরেক বেঁদে সদস্য বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমার বয়স প্রায় ৭৫ বছর। আমার জন্মটাও হয়েছিল গাওয়লে। এখন আবার আমার মেয়ের উদরে একটি নাতিরও জন্ম হয়েছে এই গাওয়ালে এসে। শিশু নাতিটির বয়স মাত্র ৪ মাস হলো।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের শতকরা ৯০-৯৫ জন দরিদ্রসীমার নিচেই বসবাস করছি। আমাদের বিশুদ্ধ পানি পান কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেসন ব্যাবস্থা নেই। এখানে এসে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি তবে কে বা কাহারা যেনো গত রাতে আমাদের অস্থায়ী টয়লেটে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষা দিক্ষা নেই বলেই এখন আমাদের সম্প্রদায়ের লোকদেরকে মানুষ তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা করেই দেখে। আমাদের সাথে কেউ মিশতে চায় না, আমরা সমাজে ভালো ভাবে বাচতে চাই, আমরাও সুন্নি মুসলমান, চাই আমাদের সন্তানদের সাধারণ শিক্ষা বা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে, কিন্তু দরিদ্রতা আর সমাজের অবজ্ঞা আমাদের প্রধান বাধা।’
গাওয়ালে আপনাদের কেউ মারা গেলে কি করেন? এমন কথার জবাবে ছলছল চোখে ফরিদ মিয়া বলেন, ‘আমাদের কারো সামর্থ থাকলে সাভার মাংতা পাড়ায় নিয়ে যায়, আর না থাকলে বহরের কাছাকাছি সরকারি গোরস্থান থাকলে মুসলিম বিধানমতে সেখানে দাফন করা হয়। আর সরকারি গোরস্থান না থাকলে দাফনের জন্য স্থানীয় সুশীল সমাজ সহায়তা করেন।’
এ বিষয়ে ভোলা সমাজ সেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক রজত শুভ্র সরকার বলেন, ‘বেদে সম্প্রদায়ের ভাসমান মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য পঞ্চাশোর্ধ বয়সীদের জন্য ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে, এ সুবিধা ভোগীরা অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। অপরদিকে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সনির্ভর করতে এবং তাদেরকে শিক্ষায় মনোযোগী হওয়ার জন্য প্রাথমিক উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। তবে তারা আমার জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হলে আবেদনের প্রেক্ষিতে সুবিধা প্রদান করা হবে। তারা ভাসমান হলে এনআইডি যেখানে করা হয়েছে সেখানেই আবেদন করলে সুবিধাদী ভোগ করতে পারবেন। আমরা সমাজ সেবা সরকারি অধিদফতর বেঁদে সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে সমাজে অন্য সব সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করার সুযোগ তৈরিতে বদ্ধপরিকর।’
আরও পড়ুন: