পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করার পরও সাক্ষ্য না দেওয়ায় বিনাদোষে বেসামরিক কর্মচারী (ঝাড়ুদার) বাবুল হোসেন ইকবালকে করা হয় আসামি। অবশ্য তার বিরুদ্ধে কোনও সাক্ষী না থাকায় ২০১৩ সালে হত্যা মামলা থেকে অব্যহতি পান তিনি। এরপরও বিস্ফোরক মামলার আসামি দেখিয়ে তাকে রাখা হয় কারাবন্দি করে। ফ্যাসিবাদী সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর গত ১৯ জানুয়ারি বাবুলসহ ১২৬ জনকে জামিন দেয় আদালত। ২৩ জানুয়ারি তারা কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন।
জেল জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে, তার মা আয়েশা বেগমের মৃত্যুর খবর সময় মতো তিনি পাননি। শেষ বারের জন্য মায়ের মুখটিও তিনি দেখতে পারেননি। তার ইচ্ছে ছিল, কারামুক্ত হলে মাকে তার সঙ্গে রাখবেন। নিজেই করবেন মায়ের সেবা-যত্ন। কিন্তু একবছর আগে তার মা মারা যায়। মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা হল না তার।
জামিনে মুক্ত হওয়া বাবুল লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালালবাজার ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মহাদেবপুর গ্রামের মহররম আলী বেপারী বাড়ির মৃত মিজহারুল ইসলামের ছেলে। তিনি পিলখানায় ঝাড়ুদার (এনসি) ছিলেন। পারিবারিকভাবে ১৯৯৭ সালে নিলা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। তার চাকরির বয়স যখন ১৫ বছর, তখন তার মেয়ে নিলার বয়স ছিল সাড়ে ৬ কিংবা ৭ বছর। নিলা তখন প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের পর প্রায় ১ মাস তিনি পিলখানাতেই চাকরিরত ছিলেন। তখন মোবাইলফোনে নিয়মিত বাড়িতে যোগাযোগও করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী না হওয়ায় আসামি হয়ে তাকে যেতে হয় কারাগারে। ১৫ বছর ১০ মাস পর কারাবন্দি থেকে তিনি মুক্ত হয়েছেন।
বাবুলের মেয়ে ফারজানা আক্তার নিলা বলেন, প্রায় ১৬ বছর কারাগারে বন্দি ছিল বাবা। আমি বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। অনেক কষ্টে মা আমাকে পড়ালেখা করিয়েছেন। এরপর আমি প্রায় ৪ বছর একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি। বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে।
বাবুলের স্ত্রী নিলু বেগম বলেন, বিনাদোষে আমার স্বামীকে হত্যা মামলায় কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। পরে খালাস পেলেও আরও একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আর বের হতে দেয়নি। অনেক কষ্টে আমাদের দিনাতিপাত করতে হয়েছে। ২০১১ সালে বাবুল আমাকে বলেছিল, জীবন নষ্ট না করে ননদের কাছে মেয়েকে রেখে চলে যেতে। আমি বলেছি, যাবো না। আমি মেয়েকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগীতায় বাবুলের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াছ হোসাইন এর উছিলায় আমার স্বামী আজ মুক্ত। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি, বাবুলকে যেন চাকরি ফিরিয়ে দেয়। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসের পর থেকে তার বেতন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তা যেন আমাদেরকে দিয়ে দেয়।
বাবুল হোসেন ইকবাল বলেন, আমরা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলাম। অস্ত্র চালানোতো দূরের বিষয়, কাছে যাওয়ারও সুযোগ ছিল না। আমাকে হত্যার ঘটনায় সাক্ষী দিতে বলা হয়। সাক্ষী না দেওয়ায় আমাকে হত্যা মামলায় জড়িয়ে দেয়। আমার বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী না থাকায় মামলা থেকে আমাকে খালাস দেওয়া হয়। আমাদেরকে বের হতে দেবে না বলেই, পরে আবার বিস্ফোরক মামলায় কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে।
বাবুল আরও বলেন, ২০০৯ সালে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের সময় আমি পিলখানাতেই ছিলাম। তবে আমি গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি। কি হয়েছে, কারা করেছে, তা দেখিনি। শুধু দেখেছি ১০-১৫ জন সৈনিক অস্ত্র নিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে। এরপর প্রায় ১ মাস পিলখানাতেই ছিলাম। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সারাহ খাতুন বলেছেন ‘তোমরা আমার সন্তান, তোমরা কোন কিছু করবা না, তোমাদেরকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছে, তোমরা এখানে থাকো’। কিন্তু ২৩ মার্চ আমাকে গাড়িতে করে প্রথমে আদালতে ও পরে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। সিআইডি, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: