
গেল বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানের পর সারাদেশের প্রেসক্লাব ফ্যাসিবাদের রাহুমুক্ত হলেও চিত্র বদলায়নি চুয়াডাঙ্গা জেলার ঐতিহ্যবাহী জীবননগর প্রেস ক্লাবের। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনও প্রেসক্লাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
পতিত সরকারের সময়ের মতোই সরকারী কর্মকর্তা, ছাত্রজনতা এবং বিএনপি জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে ফ্যাসিস্টরা। জীবননগর প্রেস ক্লাবকে সংস্কার করার প্রয়োজন দেখা দিলেও পদ ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে আছে আওয়ামী দোসররা।
সুত্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জীবননগর প্রেস ক্লাবে ১১ জন কার্যকরী সদস্যসহ কমিটিতে সর্বমোট সদস্যের সংখ্যা ৩০ জন। এদের মধ্যে ভুয়া বা প্রকৃত সাংবাদিক নন এমন সদস্য রয়েছেন ৯ জন। এই ভুয়া ৯ জন কোন পত্রিকার প্রতিনিধি জানেননা স্বয়ং প্রেস ক্লাবের অনেক সদস্যই।
ওই সুত্রের দাবী, জীবননগর প্রেসক্লাব আওয়ামী দোসরদের দখলে রয়েছে যুগযুগ ধরে। নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আদেও সাংবাদিক নন এমন নয় জনকে সদস্য পদ প্রদান করেছে তারা। কারণ হচ্ছে তারা যেন বারবার এদের মতের ভিত্তিতে বা সিলেকশনে (যেহেতু নির্বাচন হয়না) কার্যকরী কমিটির পদে থাকতে পারেন। এককথায় স্বৈরাচারী কায়দায় দীর্ঘ মেয়াদে যেন প্রেস ক্লাবের পদে থাকা যায় সেই ব্যাবস্থা পাকা করে রাখা।
তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত সাধারণ সভায় ৩০ সদস্যের সম্মতিক্রমে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে অন্যতম সুবিধাভোগী মাহবুবুর রহমান বাবু (এম আর বাবু) সভাপতি ও কাজী সামসুর রহমান চঞ্চল সাধারণ সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন।
সহ সভাপতি পদ নেন নারায়ন চন্দ্র ভৌমিক, সহ সাধারন সম্পাদক মুন্সী রায়হান, অর্থ বিষয়ক সম্পাদক মামুন উর রহমান, দপ্তর সম্পাদক মোঃ হুমায়ুন কবির, সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদ শেখ শহিদ, প্রচার সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলাম।
আর কার্যকরী সদস্য পদ নেন সালাউদ্দিন কাজল, মোহাম্মদ আকিবুল ইসলাম ও ফয়সাল খবির।
জানা গেছে, এই ১১ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটির সভাপতি এম আর বাবু পারিবারিক ভাবেই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে জড়িত। আর সহ সভাপতি পদ বাগিয়ে নেয়া নারায়ন চন্দ্র ভৌমিক সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজী সামসুর রহমান চঞ্চল সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
দপ্তর সম্পাদক মোঃ হুমায়ুন কবির ও প্রচার সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলামের আওয়ামী লীগে পদ পদবী না থাকলেও সংগঠনটির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
আর কার্যকরী সদস্য সালাউদ্দিন কাজল উথুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক।
আকিমুল ইসলাম বৃহত্তর উথুলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান জীবননগর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ফয়সাল খবির উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।
কার্যকরী কমিটির বাকি তিন সদস্য সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, আওয়ামী দোসরদের সঙ্গে জড়িত জীবননগর প্রেস ক্লাবের কর্তারা ভিন্নমতের সদস্যদের সব সময় দলীয় প্রভাব বিস্তার করে দমিয়ে রাখতেন। ভয় দেখাতেন মামলা হামলার। প্রেস ক্লাবের সকল সিদ্ধান্তে না বলার কোনো সুযোগ ছিলো না অন্য সদস্যদের। তারা যে সিদ্ধান্ত নিতেন সেটাই বাস্তবায়ন হতো।
প্রেসক্লাবে সভাপতি এমআর বাবুর পরে দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যাক্তি ছিলেন কার্যকরী সদস্য সালাউদ্দীন কাজল। প্রেসক্লাবের সকল নীতিনির্ধারণী ঠিক করতেন এই দুইজন। বাকিরা ছিলেন নামমাত্র পদধারী।
এমআর বাবু ছিলেন টানা চারবারের সাধারণ সম্পাদক। পরে একবার সাধারণ সভায় আতিয়ার রহমানের বিপক্ষে হেরে ক্ষমতা হারান। পরে আবারও প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে সভাপতি আনোয়ারুল কবীরের মৃত্যু হলে সভাপতির চেয়ার দখল করেন। যা এখনো বাহাল তবিয়তে।
এদিকে কোনো কারণ ছাড়াই প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমানের সদস্যপদ বাতিল করে এম আর বাবুর নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী কমিটি। একটি পরিকল্পিত মামলায় রায় না হলেও জোর পূর্বক সদস্যপদ বাতিল করা হয় ফয়সাল মাহাতাব মানিকের।
সদস্য পদ বাতিল করা হয় সিনিয়র সাংবাদিক এস এম কামাল জোয়াদ, আবজালুর রহমান ধিরু ও সামসুল আলমের।
এদিকে সাবেক সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমান ও ফায়সাল মাহাতাব মানিক নিয়ম মেনে সদস্য পদের জন্য পূনরায় আবেদন করলেও সেটি গ্রহন করেননি সভাপতি এমআর বাবু ও সাধারণ সম্পাদক কাজী সামসুর রহমান চঞ্চল।
এ প্রসঙ্গে প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমান বলেন, আমার সদস্য পদ বাতিল করতে হলে আমাকে প্রথমে আমার অপরাধ সম্মন্ধে জানাতে হবে। তারপর সেটা নিয়ে কার্যকরী কমিটির মিটিং হবে। আমাকে কারণ দর্শানো নোটিস দিতে হবে, আমি যদি সদুত্তর দিনে না পারি বা আমি গঠনতন্ত্র বিরোধী কাজ করি তাহলেই না আমার সদস্য পদ বাতিল করা হবে। এসবের কিছু না করেই আমার সদস্য পদ বাতিল করা হলো।
তিনি বলেন, এটা হলো স্বৈরাচারী আচরণ। ফ্যাসিবাদের আচরণ। আসলে নীতিকথা তারা সহ্য করতে পারতেন না। আমি অন্যায় হলে বাধা দিতাম আমার একটাই অপরাধ। এখন সময় এসেছে এসব স্বৈরাচারের দোসরদের সরানোর। প্রকৃত সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ফ্যাসিবাদের রাহু মূক্ত করতে হবে।
ফয়সাল মাহাতাব মানিকের ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হতেই পারে। ৫ আগস্ট পরবর্তীতে আকিমুল ও মিথুন মাহমুদের নামে মামলা হলো। কিন্তু তাদের কিছুই করা হলো না। এটাই হলো ফ্যাসিবাদী চরিত্র।
সদস্যপদের জন্য পূনরায় আবেদনের ব্যাপারে আতিয়ার রহমান বলেন, আসলে আমার সদস্যপদ বহাল আছে না বাতিল হয়েছে সেটা কতৃপক্ষ আমাকে জানায়নি। আমি স্বেচ্ছায় জানতে চাইলেও উত্তর পায়নি। পরবর্তীতে আবেদন করলেও সাড়া দেয়নি।
বিষয়টি সহসভাপতি নারায়ন ভৌমিক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। একজন জানিয়েছে আমাকে জানান তিনিও বিষয়টি জানতে চাইলে সভাপতি এমআর বাবু বলেন দুজনের ফাইল টেবিলের নিচে আছে।
এদিকে সম্প্রতি জীবননগর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জড়িয়ে মনগড়া সংবাদ প্রকাশ করে ফ্যাসিবাদের অন্যতম দোসর মিথুন মাহমুদ। এতা করে উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা তাতক্ষনিক প্রতিবাদ জানালে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় ফ্যাসিবাদের দোসরখ্যাত সাংবাদিকদের।
প্রেসক্লাবের পক্ষ থেক সংবাদ মাধ্যমে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয় প্রেসক্লাবের জরুরী বৈঠকে ইউএনওর সংবাদ বর্জনের সিদ্ধান্তের কথা।
সুত্রের খবর, প্রেসক্লাবের সেই জরুরী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৫ জন সদস্য। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মিটিয়ে কোরামই পূরণ হয়নি। যে মিটিংয়ে কোরাম পূরণ হয়না সেই মিটিঙে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় কিভাবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুত্রটি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জীবননগর প্রেস ক্লাবের সদস্য নূর আলম বলেন, আমি যতটুকু জানি তাতে তো বৈঠকের কোরামই পূরণ হয়নি। তাতে সভাপতি এম আর বাবুসহ ৬ জন উপস্থিত ছিলো। যে প্রেসক্লাবে ৩০ জন সদস্য সেখানে মিটিং করল ৬ জন, আবার একটা সিদ্ধান্ত দিলো। এটা নিয়মবহির্ভূত কাজ। এটা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হয়নি। এটা তো স্বৈরাচারী ও অবৈধ সিদ্ধান্ত। ওই মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মানিনা।
তিনি বলেন, বিগত ১৮ বছরে তো আমাকে প্রেসক্লাবে ঢুকতেই দেয়নি ঠিক মতো। নানা ভাবে আমাকে অপদস্ত করতো। আমি আওয়ামী বিরোধী। যার কারণে আমাকে এলাউ করতো না। এই ফ্যাসিবাদের কারণে আমার ঘাড়ে ২৫ টা মামলা। আমাকে প্রেসক্লাব কোনোভাবে সহায়তা দেয়নি। উলটো চাপে থাকতাম।
নূর আলম আরও বলেন, ২০২৪ সালের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসআই) এর তথ্য অনুযায়ী প্রেসক্লাবের সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। শুধু মাত্র আমি বাদে। আর সভাপতিসহ সবাই এখনও বহাল তবিয়তে আছে। আওয়ামী সরকারের সকল সুবিধা নেয়ারাই এখন আবার দাপট দেখাচ্ছে।
জীবননগর উপজেলা যুবদলের যুগ্ন আহ্বায়ক জাকির আহমেদ বলেন, প্রেস ক্লাব একটি উপজেলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবননগরে এক শ্রেণির দালাল আর ফ্যাসিবাদের দোসররা মিলে গণমাধ্যমকে শেষ করে দিচ্ছে। প্রেসক্লাবটিকে দলীয় সংগঠন বানিয়ে ফেলেছে।
তিনি বলেন, প্রেস ক্লাবের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু সাধারণ সদস্যরাও আওয়ামী লীগের আমলে পেইড এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। এখনও তারা নানা সড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। প্রকৃত সাংবাদিক যারা তারা ওখানে যায়গা পাচ্ছেনা। জীবননগর প্রেসক্লাব ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে সংস্কার প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের আগে ছাত্র-জনতার বিল্পবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো প্রেসক্লাবের বর্তমান কমিটি। আমি মনে করি অবিলম্বে প্রেস ক্লাবকে ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করতে হবে। এজন্য ছাত্রজনতা থেকে শুরু করে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা করা দরকার।
জীবননগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক বলেন, শেখ হাসিনার মতো জীবননগর প্রেসক্লাবেও একনায়কতন্ত্র চলছে। এটা থেকে বের হতে হবে। উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এই প্রেস ক্লাবকে ফ্যাসিবাদের রাহুমুক্ত, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও অপ-সাংবাদিকতার কলঙ্কমুক্ত করা খুবই প্রয়োজন।
উপজেলা বিএনপির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দীন ময়েন বলেন, গত ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে জীবননগর প্রেসক্লাবে রাজত্ব কায়েম করছে সাংবাদিক নামধারী আওয়ামী স্বৈরাচারের দোরসরা। এই প্রেস ক্লাবকে অনতিবিলম্বে ফ্যাসিবাদের রাহুমুক্ত করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সদস্যরা নিজদের স্বার্থে যেসব পেশাদার সাংবাদিকদের সদস্যপদ দেয়নি তাদের বাদ দিয়ে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতে হবে। প্রকৃত সাংবাদিকদের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়েতে হবে। আমরা সঙ্গে থাকবো।
আরও পড়ুন: