
আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছিল লাগামহীন ঘোড়া। ভুয়া প্রকল্পে সরকারি শত শত কোটি টাকা লুপাট হয়েছে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এ অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার আশা করা হলেও উল্টো যেন বেপরোয়া হয়েছে আরও বেশী। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে বর্তমান মেয়াদে দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৫ মার্চ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ১ শাখার উপ-সচিব মোহাম্মদ নাহিদ ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে খাগড়াছড়ির ১ শ ৮৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাঝে ৩ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের অনুকূলে সহিসংতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সার্বিক উন্নয়ন, চিকিৎসা ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এ বরাদ্দ উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
১ শ ৮৫ টি প্রকল্পের অধিকাংশ ভুয়া প্রতিষ্ঠান, একই ব্যক্তি ও পরিবারকে একাধিক বরাদ্দ, স্বজনপ্রীতি, জেলা পরিষদ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দের চিত্র উঠে এসেছে। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ত্রিনা চাকমা একাই ১২ টি প্রকল্পে আবেদন করে সবগুলোতে ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের নামে প্রকল্প ভাগিয়েছেন তিনি। এ ত্রিনা চাকমা ছিলেন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলের সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাসহ একাধিক আওয়ামীলীগ শীর্ষ নেতার সহচর। চাকরীকালীন সময়ে এবং অবসর সময়ে আওয়ামীলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জেলা শহরের সূর্যশিখা ক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আলাদা আলাদা বরাদ্দে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। বস্তায় চাষাবাদ প্রকল্পে দেয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা, অন্যের পুকুর দেখিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান মৎস্য খাতে বরাদ্দ পেয়েছে, এ ছাড়া একই পরিবারকে চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য আলাদা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কর্মকর্তার মাধ্যমে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা বাবার প্রতিষ্ঠানে লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে তালিকার ২৭ নম্বরে থাকা খেজুরবাগান বিত্তহীন সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি নুরুচ্ছাফার মুঠোফোনে একাধিক বার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
বরাদ্দ পাওয়াদের অনেকে কখন কি নামে প্রকল্পের জন্য আবেদন করেছেন তার উত্তর দিতে পারেনি। তালিকায় ৫৪ নম্বরে আছে খাগড়াছড়ি সদরের কলেজ গেইট এলাকার পাহাড়ী বাঙালী সম্প্রীতি সমবায় সমিতির অনুকূলে আর্থ সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য বাঁধ সংস্কারসহ মৎস্য চাষ। সভাপতি হিসেবে নাম আছে নিশি মনি চাকমা নামে একজনের। মুঠোফোনে উনার কাছে প্রকল্পের অবস্থান এবং সমিতির নাম জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিতে পারেননি। বলেন স্থানীয় যুবদল নেতা নুরুল আলম তাকে আবেদন দিতে বলেছেন। তিনি আর বেশী কিছু জানেন না।
পরবর্তীতে নুরুল আলম প্রতিবেদককে ফোন করে জানান, নিশি মনি চাকমা পড়ালেখা জানেন না তাই কিছু বলতে পারেনি। তিনি সাধারণ সম্পাদক হয়ে সবকিছু দেখভাল করছেন। সমিতির নামে সমবায় শব্দ থাকলেও বাস্তবে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন নেই বলে স্বীকার করেন তিনি।
এ ছাড়া অনেক প্রকল্পের বিষয়ে জানতে তালিকা দেয়া মুঠোফোন নাম্বারে কল দেয়া হলেও নাম্বার বন্ধ পাওয়া গেছে। অনেকে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে থেকে আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় অর্থ বরাদ্দ শিরোনামে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গেল ২৬ শে মার্চ থেকে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অনেকে পোষ্ট করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। খুকু ত্রিপুরা নামে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেন, “ত্রিপুরা মারমা অনেক খেয়েছে আর না, এই উক্তিটির বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ তাহলে শুরু হলো...’’ পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা দায়িত্ব পাওয়ার পর এক অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
বিনোদন ত্রিপুরা নামে এক উন্নয়ন কর্মী লিখেন, কোন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এই তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে জাতির নিকট উন্মুক্ত করুন পার্বত্য উপদেষ্টা মহোদয়।
আরেকজন লিখেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে ২৪ এর জুলাই আন্দোলনের প্রতি চরম অসম্মান দেখিয়েছেন পার্বত্য উপদেষ্টা। নিজ জেলা খাগড়াছড়িতে ৩ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, রাঙামাটিতে ১ কোটি ২২ লাখ টাকা ও বান্দরবানে ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খাগড়াছড়িতে পার্বত্য উপদেষ্টার বাড়ি। আত্মীয় স্বজনে ভরা। তাই বিঝু উদযাপনে মনখোলে বরাদ্দ দিয়েছেন। এখানে কি অন্য দুই জেলার সাথে বৈষম্য করা হয়নি?
পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলনের খাগড়াছড়ি শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদ উল্লাহ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যায় পাহাড়ী বাঙালী উভয় সম্প্রদায়কে সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সার্বিক উন্নয়ন, চিকিৎসা ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে যে বরাদ্দ দিয়েছে তাতে আমরা দেখলাম পাহাড়ীদের মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় বেশী বরাদ্দ পেয়েছে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে বাঙালী মাত্র ৩৮ টি প্রকল্প পেয়েছে। পার্বত্য উপদেষ্টার অসৌজন্যমূলক আচরণ, অনিয়ম নিয়ে পাহাড়ে বহুবার আন্দোলন হয়েছে। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা আবারও আন্দোলনে নামব।
মনগড়া, বৈষম্যমূলক ও ভুয়া প্রকল্পের বিষয়ে জানতে একে একে কল করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার একান্ত সচিব, সচিব ও উপসচিবদের নাম্বারে। উপদেষ্টার একান্ত সচিব খন্দকার মুশফিকুর রহমানের মুঠোফোনে কল রিসিভি করে এ বিষয়ে সচিবের সাথে কথা বলতে বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। সচিবের দপ্তরের ল্যান্ড ফোনে কল করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানানো হয়। পরবর্তীতে কল দেয়া হলে আর রিসিভ হয়নি। বরাদ্দ স্বাক্ষরকারী মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ১ শাখার উপ-সচিব মোহাম্মদ নাহিদ ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সংযোগ কেটে দেন।
প্রভাবশালী সদস্যের যোগসাজস:
পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ আসলেও মূলত আবেদন গ্রহণ ও বাছাই কাজে বড় ভূমিকা পালন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ গুলো। এ ক্ষেত্রে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অনেকে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের মন রক্ষায় নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। অভিযোগ উঠেছে জেলা পরিষদ সদস্য ও উপদেষ্টার জেঠাত ভাই বঙ্গমিত্র চাকমা এ সব বরাদ্দে বড় প্রভাব বিস্তার করেছে। এ বিষয়ে জানতে বঙ্গমিত্রের মুঠোফোনে কল ও হোয়াটস অ্যাপে খুদে বার্তা দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
আরও পড়ুন: