শুক্রবার

১৮ এপ্রিল, ২০২৫
৪ বৈশাখ, ১৪৩২
২০ শাওয়াল, ১৪৪৬

আওয়ামী লীগ নেতাদের ত্রাসে কাঁপছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মামলা তুলে নিতে বোমাবাজি ও প্রাণনাশের হুমকি

প্রতিনিধি,চাঁপাইনবাবগঞ্জ

প্রকাশিত: ৯ এপ্রিল, ২০২৫ ২১:৫৪

শেয়ার

আওয়ামী লীগ নেতাদের ত্রাসে কাঁপছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মামলা তুলে নিতে বোমাবাজি ও প্রাণনাশের হুমকি
ছবি : বাংলা এডিশন
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার ১২ নং চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নে চলছে চরম অস্থিরতা ও আতঙ্ক। আলোচিত চাঞ্চল্যকর  পিন্টু হত্যা মামলার মূল আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া এবং বাদীপক্ষের উপর ক্রমাগত হুমকি, অপপ্রচার ও সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে ক্ষোভে ফুঁসছে স্থানীয় জনতা। নিহত পিন্টুর পরিবার ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, মামলা থেকে বাঁচতে প্রভাবশালী আসামিপক্ষ নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আসামীরা কখনো ভয়ভীতি প্রদর্শন, আবার কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে মামলার গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
 
পিন্টুর পরিবার দাবি করছে, পিন্টু নিয়মিতভাবে শহীদ রানা টিপুর মাদক কারবার সংক্রান্ত তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরবরাহ করতেন, আর সেই কারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। মামলার অন্যান্য অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছে সাহারুল আলম কালু, মিজানুর রহমান মিজান, আজিজুল ইসলাম ও আশরাফ আলীর মতো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
 
তদন্তে ধীরগতি এবং প্রধান আসামিদের গ্রেপ্তারে ব্যর্থতা দেখে এবং একের পর এক হুমকি-হামলার ঘটনায় হতাশ হয়ে পড়েছে নিহতের পরিবার। তারা বলছেন, খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ বাদীপক্ষের জীবন এখন হুমকির মুখে।
 
এ অবস্থায়, ২ এপ্রিল বিকেলে শহীদ রানা টিপুর অনুসারীরা নিহত পিন্টুর পিতা ও ভাইয়ের দোকান খুলতে বাধা প্রদান করে এবং হামলা চালিয়ে জীবননাশের হুমকি দেয়। স্থানীয়দের দাবি, দোকানে ভাঙচুর চালিয়ে মামলাটি তুলে নিতে চাপ সৃষ্টি করা হয়। ঠিক সেই রাতেই চরবাগডাঙ্গায় একাধিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটে, যা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও মাদক সম্রাট ইউপি চেয়ারম্যান শহীদ রানা টিপুর অনুসারীদেরই কাজ বলে অভিযোগ উঠেছে। বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি হয়। ৩ এপ্রিল রাতেও আবারো বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যা এলাকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আরও ভয় ও অস্থিরতা তৈরি করে।
 
এই হামলার ঘটনায় নিহত পিন্টুর পিতা মো. হুমায়ুন ৩ এপ্রিল নতুন একটি মামলা দায়ের করেন, যেখানে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, মামলার সাক্ষীদের হুমকি, দোকান ভাঙচুর, প্রাণনাশের ভয় এবং বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলার উদ্দেশ্য পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
 
এদিকে, নতুন মামলার প্রতিক্রিয়ায় শহীদ রানা টিপুর অনুসারীরা পাল্টা একটি ইজহার দাখিল করেন ৪ এপ্রিল, যেখানে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তবে পুলিশ জানায়, এটি জিডি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, কারণ এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিপরীতে, পিন্টুর বাবার দায়ের করা মামলার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে।
 
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্‌) এএনএম ওয়াসিম ফিরোজ বাংলা এডিশন কে জানান, ককটেল বিস্ফোরণ ও হুমকির বিষয়ে তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেছে এবং সেই ভিত্তিতেই মামলা গ্রহণ করা হয়েছে।
 
এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিহতের পিতা মো. হুমায়ুন প্রকৃতপক্ষে একজন নির্যাতিত ব্যক্তি, যিনি পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে থানায় মামলা করেছেন। অথচ উল্টো খুন ও নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্তরাই সাধারণ নিরীহ মানুষদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাদের হয়রানি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই—পিন্টু হত্যার মতো একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার দায় থেকে যেকোনো মূল্যে রেহাই পাওয়া। স্থানীয়দের মতে, এই পাল্টা মামলা মূলত খুনীদের অপরাধ ঢাকতে এবং সাক্ষীদের মুখ বন্ধ রাখতে একটি পরিকল্পিত কৌশল।
 
নিহতের স্ত্রী পারভীন বেগমের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শুরুতে তিনি খুনিদের বিরুদ্ধে সরব থাকলেও এখন আচমকা তাদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পরিবারের।
 
নিহতের বোন জান্নাতুন খাতুন লাবনী জানান, "পারভীন বেগম আগে খুনিদের শাস্তির দাবি তুললেও এখন বলছেন, তারা নিরপরাধ। এটা প্রমাণ করে তিনি টাকার বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়েছেন।"
 
নিহতের পিতা মো. হুমায়ুন বলেন, “আমার ছেলে ছিলো মাদকবিরোধী সোর্স। সে শহীদ রানা টিপুর মাদক কারবারের তথ্য দিয়ে ফেলায় তাকে হত্যা করা হয়। এখন খুনীদের বাঁচাতে আমার ছেলের স্ত্রীকে ব্যবহার করছে তারা। আমার করা মামলার বাইরে সে আরেকটি মামলা দিয়েছে, যেখানে নিরপরাধদের আসামি করা হয়েছে। সে এখন খুনীদের পুতুল হয়ে গেছে।”
 
এই বিষয়ে নিহত পিন্টুর স্ত্রী পারভীন বেগমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
 
চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “দেশজুড়ে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চললেও টিপু কীভাবে প্রকাশ্যে থাকে? এই প্রশ্ন এখন সবার মনে।” স্থানীয়রা জানান, টিপুর অনুসারীরা নির্লজ্জভাবে বলছে, “একটা খেয়েছি, আরও খাবো। কেউ কিছু করতে পারবে না।”
 
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে মামলার প্রধান আসামি মোঃ শাহিদ রানা টিপুসহ অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রত্যেকের ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, গ্রেপ্তার এড়াতেই আসামিরা সবাই আত্মাগোপনে রয়েছে।
 
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মতিউর রহমান বাংলা এডিশন কে বলেন, পিন্টুর বাবা হুমায়ুনের দায়ের করা মামলায় ২০ জন এজাহারনামীয় আসামির মধ্যে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ এবং বাকি আসামিদের আটক করতে কাজ করছে তারা। তবে নিহতের পরিবার বলছে, এই কথাবার্তা কেবল আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
 
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী ও নিহতের পরিবার একসঙ্গে বলছেন—এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা শহীদ রানা টিপুসহ সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে চরবাগডাঙ্গা আবারও রক্তাক্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
 
জানা যায়, ২০২৫ সালের ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোপন সোর্স হিসেবে পরিচিত আব্দুল হাকিম পিন্টুকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। পরবর্তীতে ২৩ জানুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পরদিন ২৪ জানুয়ারি নিহতের পিতা মো. হুমায়ুন সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও আলোচিত মাদক ব্যবসায়ী শহীদ রানা টিপুকে নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আরও ১৯ জনের নামও উল্লেখ করা হয়, যাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই মাদক ব্যবসা ও নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
banner close
banner close