শনিবার

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
১৩ আশ্বিন, ১৪৩১
২৫ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

জুলাই গণহত্যায় দেড় শতাধিক ছাত্র খুন করে জঙ্গী নাটকের হোতা আসাদ-নজরুলের সিটিটিসি

মো. ইলিয়াস হোসাইন

প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট, ২০২৪ ০১:৩১

শেয়ার

জুলাই গণহত্যায় দেড় শতাধিক ছাত্র খুন করে জঙ্গী নাটকের হোতা আসাদ-নজরুলের সিটিটিসি
সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

৩৬ মিন্টু রোড, সিটিটিসির ভবনের ৭ তলা৷ গেলো ৮ বছরে এই তলাতে কতো নিরিহ নিষ্পাপ মানুষের জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছে তার কোনো হিসেব নাই৷

২০০৯ সালে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার নানা ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়৷

জঙ্গি নিউজ

আওয়ামী সরকারের এই জঙ্গি নাটক কে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সবচেয়ে বেশি রক্ত দিতে হয়েছে এদেশের আলেম সমাজকে৷ মাদ্রাসা ছাড়াও স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীরা কিছুটা ধার্মিক, তাদেরকেও টার্গেট করে জঙ্গি হিসেবে মিডিয়া ট্রায়াল দেয়া হতো৷  

এসব নাটকগুলোর অধিকাংশের স্ক্রিপ্ট ছিল প্রায় একই রকম৷ সব ক্ষেত্রেই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গভীর রাতে কোন একটি বাড়িতে অভিযান চালানো হয়৷ রাতভর বাড়িটি ঘিরে রাখার খবর গণমাধ্যমে ব্রেকিং চলবার পর ভোররাতে ঘরে ঢুকে কথিত জঙ্গী ধরে আনা হত৷

পরদিন সকালে যে প্রেস ব্রিফিং হবে সেই খবর আগের দিনই গনমাধ্যমে পাঠানো হয়৷ পরদিন গণমাধ্যমকে কি ব্রিফিং করা হবে সেটাও সাজানো থাকতো আগে থেকেই৷  

বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানগুলো সাংবাদিকদের জানিয়ে করা হতো, এমনকি বিভিন্ন টেলিভিশনের লাইভের মাধ্যমে দেখানোর সুযোগ দেয়া হতো৷ কিন্তু, আওয়ামী লীগের জঙ্গি অভিযানেত তথ্য আজ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিকদের আগে থেকে জানানো হয়নি৷ বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রাখার নাটক সাজানো হলেও তার ভেতরে কি করা হচ্ছে তা দেখার সুযোগ কোনো সাংবাদিকের হয়নি৷  

এ ধরনের নাটক সাজিয়ে গেল ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার কত মানুষকে গুম খুন আর কতো মানুষকে বছরের পর বছর জেলখানায় বন্দি রেখেছে তার কোন হিসেব নেই৷

আওয়ামী লীগের গেলো ১৫ বছরের বাংলাদেশ দাড়িটুপি ওয়ালা মানুষের জন্যে কঠিন হয়ে উঠেছিলো৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এদেশকে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হাসিনা সরকার নতুন নতুন জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করতে থাকে৷

এরই ধারাবাহিকতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে কাউন্টার টেররিজম পুলিশ ব্যুরো নামে একটি বিশেষ ইউনিট গঠনের সুপারিশ করে এবং এর প্রয়োজনীয়তা কতো প্রকট সেটা বুঝানোর জন্যে প্রথমে সাজানো হয় হলি আর্টেজেনে জঙ্গি হামলার নাটক৷  

সারা দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশকে জঙ্গি হিসেবে পরিচিত করবার পর ২০১৬ সালে ৬০০ জনকে নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের নতুন আরেকটি শাখা উদ্বোধন করা হয় জান নাম রাখা হয় কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম৷ সংক্ষেপে যাকে বলা হয় সিটিটিসি৷

প্রথম দিকে পুলিশের এই বিশেষ শাখাটি খুব বেশি সামনে আসতে না পারলেও ২০২১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাসের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে উপ মহা পুলিশ পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামানকে সিটিটিসির প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়৷

বিশেষভাবে হকপন্থি আলেমদেরকে বেছে বেছে জঙ্গী বানানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এজেন্ট ধনঞ্জয় তাকে এই পদে বসায়৷ গোল্ড স্মাগলার ধনঞ্জয়ের সঙ্গে আগে থেকেই আসাদুজ্জামানের ঘনিষ্ঠতা থাকায় ধনঞ্জয় কোটায় সিটিটিসির প্রধানের পদ বাগিয়ে নেয় সে৷

ভারতীয় কোটায় দায়িত্ব পেয়েই একের পর এক সুপার ডুপার হিট সব জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করতে থাকে আসাদুজ্জামানের সিটিটিসি৷

এমনকি বিদেশে বসে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেও তাদেরকে টার্গেট করে নানা ধরনের গাঁজাখুরি গল্প সাজাতো আসাদুজ্জামান৷

আসাদের সাজানো এসব নাটকগুলোও সব প্রায় একই রকম৷ দাড়িটুপিওয়ালা লোকজনকে ধরে নিয়ে গুম করে রাখা হতো কয়েকমাস৷ এরপর গুম হয়ে থাকা আলেমদেরকে হঠাৎ করেই কোন এক কথিত জঙ্গি আস্তানায় আবিস্কার করা হতো৷ এসব নাটক করতে গিয়ে দেড় মাসের শিশুকে পর্যন্ত হত্যা করেছে পাষণ্ড আসাদুজ্জামান৷

এদেশের সাংবাদিকরা আসাদুজ্জামানের এসব গাঁজাখুরি গল্প কে কখনোই কোনো অনুসন্ধান না করেই, একপাক্ষিক খবর প্রচার করে নিরীহ মানুষগুলোর জীবন শেষ করে দিতো৷

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে তার অপরাধ প্রমাণিত হবার আগ পর্যন্ত অপরাধী বলা যাবে না৷ যে কারণে আটক ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বিধান রয়েছে৷ কিন্তু, কেন ১৫ বছর ধরে দেখা গেছে এক অদ্ভুত দৃশ্য৷

মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো এবং তারপর তাদেরকে মিডিয়ার সামনে এনে হাজির করার পর কোন ধরনের বিচার তদন্ত ছাড়াই বিচারকের মত তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলতো৷

আসাদুজ্জামানের সিটিটিসিতে যাদেরকেই আটক করা হতো তাদের পরিবারের কাছ থেকে নেয়া হতো মোটা অংকের টাকা৷। এসব টাকাপয়সা কালেকশনের দায়িত্ব ছিলো আসাদুজ্জামানের স্টেনোগ্রাফার নজরুল ইসলাম প্রামানিকের৷ আসাদুজ্জামানের এই অন্ধকার জগতের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতো নজরুল ইসলাম৷

পুলিশের একটি সুত্র জানিয়েছে, শুধুমাত্র আসাদুজ্জামানের পিওন নজরুল ইসলাম প্রমানিকের ঢাকার উত্তরা মিরপুর আর গ্রামের বাড়ি জামালপুরে মিলিয়ে অন্তত ১শ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে, আর আসাদুজ্জামানের সম্পত্তির পরিমান কতো সেটা হয়তো সে নিজেও জানেনা৷

তবে, আমাদের এই বিশেষ প্রতিবেদনটির মূল বিষয় তাদের সম্পত্তির হিসেব বের করা নয়; বরং এই দুজনের ফাঁসির আবেদন জানানো৷  

শুধু একবার ফাঁসি নয়, এই দুজনকে কয়েকশ বার ফাঁসি দিলেও তাদের শাস্তি শেষ হবেনা। এর কারন এদের বিরুদ্ধে গা শিউরে ওঠার মতো কিছু তথ্য আমাদের জানিয়েছে পুলিশের একটি সুত্র।

সুত্রটি জানিয়েছে, জুলাইয়ে ছাত্রদের ওপরে যে গনহত্যা চালানো হয়েছে তারমধ্যে বড় একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছে সিটিটিসির আসাদুজ্জামান এবং তার স্টেনো এসআই নজরুল ইসলাম প্রামানিক৷  

এসআই নজরুল ইসলাম প্রমানিকের নেতৃত্বে ১৭ জুলাই রাতে সিটিটিসির মোট ৫টি গাড়ি বের হয়৷ এই গাড়িগুলোতে অস্ত্র ভর্তি করে ঢাকা দক্ষিনের প্রতিটি ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে গিয়ে তালিকাভুক্ত ছাত্রলীগ যুবলীগের কাছে পৌছে দেয় নজরুল৷ আসাদুজ্জামানের নির্দেশে ওই রাতে মোট সাড়ে তিনশ অস্ত্র সরবরাহ করা হয় আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলি চালাতে৷  

হাসিনা সরকারকে যে কোন উপায়ে টিকিয়ে রাখতে যতো লাশ প্রয়োজন তত লাশ ফেলার পরিকল্পনা ছিলো সিটিটিসির৷ সুত্রের তথ্যানুযায়ী, ১৭ই জুলাই সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার সময় থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত আসাদ এবং নজরুলের নেতৃত্বে অন্তত দেড়শ আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়৷

বিভিন্ন জায়গায় গাড়িতে করে লাশ ফেলে আসার যে দৃশ্য দেখা গেছে, সেগুলোরও বেশিরভাগ সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামানের নির্দেশে নজরুল পালন করেছিলো৷  

এসব হত্যাকান্ডগুলো নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় ঘটানো হলেও তারা সেই লাশগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখে, যেন এসব লাশ দেখে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷  

হাসিনার ওপরে ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপের বিষয়টি সবার কাছে গোপন রাখায় পুলিশ মনে করেছিলো ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি ও জামায়াতের ব্যাপক আন্দোলনের পর যৌথ বাহিনী দিয়ে নির্বিচারে বিএনপি জামায়াত নিধন কিংবা শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের রাতের মতো গনহত্যা চালিয়ে এবারের আন্দোলনকেও থামিয়ে দেয়া যাবে৷

যে কারনে ৪ তারিখ রাতেও আসাদ-নজরুলদের পরিকল্পনা ছিলো ৫ তারিখে ব্যাপক গনহত্যা চালানো৷ কিন্তু হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় সেটা আর সম্ভব হয়নি৷ ৫ তারিখ বিকেল পর্যন্ত আসাদুজ্জামান চেষ্টা করেছে এরপরেও যদি কিছু করা যায়; কিন্তু পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকায় আসাদুজ্জামান গা ঢাকা দেয়৷

যদিও তার স্টেনো এসআই নজরুল ইসলাম ৫ আগস্টের পরেও অনেকে অফিসে দেখেছেন৷  

সিটিটিসির নৃশংস এই বর্বরতম গনহত্যার খবরে বর্তমান আইজিপি থেকে শুরু করে ডিএমপি কমিশনার সকলেই হতবাক৷ যে কারনে গেলো ১৯ তারিখে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়৷ কিন্তু এস আই নজরুল ইসলামের ব্যাপারে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি৷

যে কারনে যেসব পুলিশের সদস্যরা তাদের এসব নৃশংসতা দেখেছেন তারা দাবি করেছেন, সিটিটিসি প্রধানকে শুধু চাকরি থেকে অব্যাহতি নয় দ্রুত সময়ের মধ্যে থাকে গ্রেফতার করে ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে৷

সেই সঙ্গে আস্তাদুজ্জামানের স্টেনোগ্রাফার নজরুল ইসলাম প্রামানিককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকেও দ্রুত গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে৷

মনে রাখতে হবে জুলাইয়ের গনহত্যায় শহীদদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ ২য় বারের মতো স্বাধীন হয়েছে৷ তাদের বুক থেকে যারা রক্ত জড়িয়েছে যারা হাজারও শহীদের মায়ের বুক খালি করেছে তাদের কাউকেই এক ইঞ্চি ছাড় নয়৷