রবিবার

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
১৩ আশ্বিন, ১৪৩১
২৫ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

ধর্ষণের রামরাজত্বে পরিণত হয়েছে ভারত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৯:১৮

আপডেট: ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০১:৫৭

শেয়ার

ধর্ষণের রামরাজত্বে পরিণত হয়েছে ভারত
ধর্ষণের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে ভারতের নারীরা। ছবিঃ সংগৃহীত

ভারতে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা পরিণত হয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রীতিমতো গণধর্ষণের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে এ দেশটি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসারে, সারা বিশ্বের মধ্যে ধর্ষণে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর একটি ভারত।

দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-এনসিআরবির হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে দেশটিতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালে গড়ে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে ধর্ষণের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। সমাজতাত্ত্বিক ও বিশ্লেষকদের মতে আইনের দুর্বলতা, বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ভারতে ধর্ষণ বেড়ে চলার অন্যতম প্রধান কারণ।

আগস্টের ৯ তারিখ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় আরজে কর হাসপাতালে ট্রেইনি চিকিৎসক মৌমিতা দেবনাথকে গণধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে বিক্ষুব্ধ নারীসমাজ। এই ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার চায় তারা। চায় নিজেদের নিরাপত্তা।

প্রতি বছর মৌমিতার মতো হাজারও ভারতীয় নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হতে হয়। বলা যায়, ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায় না এমন একটি দিনও যায় না। এই পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। পৈশাচিক উপায়ে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এর সর্বশেষ নমুনা কলকাতার চিকিৎসক মৌমিতা। এ অবস্থায় ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ভারতের নারীরা।

ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-এনসিআরবির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর দেশটিতে ৩৩ থেকে ৩৯ হাজার ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কোভিড মহামারীর সময়ে ২০২০ সালে এমন অভিযোগের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে কম- ২৮ হাজার ৪৬টি। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ২০১৬ সালে ছিল- সর্বোচ্চ ৩৮ হাজার ৯৪৬টি।

এনসিআরবির তথ্য মতে, ভারতে ধর্ষণের শিকার বেশিরভাগ নারীর বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এছাড়া ভুক্তভোগীদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের বয়স ১৮ বছর ও প্রতি দশজনের মধ্যে একজনের বয়স ১৪ বছরের নিচে।

২০২২ সালে প্রকাশিত সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে ভারতে ৩১ হাজার ৫১৬টি ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৬৭৭টি। সেই হিসেবে সে বছর প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

প্রদেশ অনুসারে, ২০২১ সালে রাজস্থানে সবচেয়ে বেশি ৬ হাজার ৩৩৭টি ধর্ষনের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ছাড়া মধ্য প্রদেশে ২ হাজার ৯৪৭টি, মহারাষ্ট্রে ২ হাজার ৪৯৬টি, উত্তর প্রদেশে ২ হাজার ৮৪৫টি ও দিল্লিতে ১ হাজার ২৫০টি ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। এসবের বাইরেও ২০২১ সালে ভারতে প্রতি ঘণ্টায় নারীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৪৯টি যৌন নির্যাতন ও অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কথা জানিয়েছে এনসিআরবি।

চলতি বছরের আগস্টে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ভারতে গড়ে প্রত্যেক ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে রাজধানী নয়াদিল্লীতে। ২০২২ সালে এখানে প্রতিদিন গড়ে ৪টি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

সমাজতাত্ত্বিক, বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে, পরিসংখ্যানে উঠে আসা সংখ্যার চেয়ে ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের যে সংখ্যা দেখা যাচ্ছে তা ডুবে থাকা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। মূলত সামাজিক লাঞ্ছনার ভয় ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কারণে ধর্ষণের ভুক্তভোগী বা তার পরিবার অভিযোগ জানায় না।

কেন দিন দিন ভারত নারীদের জন্য বিভীষিকাময় হয়ে উঠছে, কেন বাড়ছে পৈশাচিক ধর্ষণ, এর জন্য বেশ কিছু কারণকে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর জন্য বড় আকারে কর্তৃত্ববাদী পিতৃতন্ত্র, দুর্বল আইন ও বিচার ব্যবস্থা, সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন তারা। ভারতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া অনেক ধীরগতির। বছরের পর বছর ঝুলে থাকে এগুলো।

এর সঙ্গে আছে এসব ঘটনায় যথাযথ তদন্ত ও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের অভাব। এর বাইরে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ রয়েছে। তাদের হস্তক্ষেপে বা যথাযথ তথ্য প্রমাণের অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।

সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতে বর্ণপ্রথা ও আধিপত্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার কারণে দলিত বা ছোট বর্ণের নারী ও সংখ্যালঘুরা বেশি ধর্ষণের শিকার হন। ভারতে বেকার সমস্যাও প্রকট। বেকারত্বজনিত হতাশাকেও ধর্ষণের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

২০১২ সালে দিল্লীতে ২৩ বছর বয়সী তরুণী জ্যোতি সিংয়ের গণধর্ষণের পর ভারতে বড় আকারে ধর্ষণ বিষয়ক আইনি ও বিচারিক সংস্কার করা হয়। ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।

এ ছাড়া ধর্ষিতার বয়স ১২ বছরের নিচে হলে কার্যকর করা হবে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড। তবে এতো কিছুর পরও ভারতে ধর্ষণের ঘটনা কমছে না। উল্টো বাড়ছে। ২০১২ সালের দিকে ভারতে গড়ে বছরে ২৫ হাজারের মতো ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেলেও পরবর্তী বছরগুলোতে বাৎসরিক ধর্ষণের অভিযোগ গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজারের ওপরে।

আসলে ধর্ষণের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।

এনসিআরবির তথ্য মতে, ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার খুবই কম। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৭ থেকে ২৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে ভারতে ধর্ষণের বিষয়টির এক ধরনের স্বাভাবীকরণ ঘটেছে।

অনেক ধর্ষকই মনে করে তারা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে বা আইনের ফাঁকফোকর গলে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়ে যাবে। আইনের প্রতি তাদের কোনো সমীহ নেই।

অন্যদিকে, ধর্ষণের এই মহামারি বন্ধে সোচ্চার সারা ভারতের নারীরা। তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে পথে নেমেছে দায়িত্বশীল পুরুষরাও। তাদের একটাই দাবি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করো। অপরাধীদের যথার্থ বিচারের আওতায় আনো। বন্ধ করো পৈশাচিক ধর্ষণ।