বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট নিয়ে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে চলছে নানা প্রতিক্রিয়া। কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। ঠিক এমন সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে চার দিনের ব্যবধানে এসেছে অপরিশোধিত ৫২ হাজার টন সয়াবিন তেলের চারটি জাহাজ। যদিও জাহাজগুলো ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনারের থেকে এক মাস আগেই রওনা হয় চট্টগ্রামের উদ্দেশে।
ব্যবসায়ীরা জানান, সরবরাহ বাড়ায় বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের যে সাময়িক সংকট চলছে তা কেটে যাবে। সোমবার সয়াবিনের দাম সমন্বয় করায় রোজার আগে আমদানি আরও বাড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, শনিবার এমটি আরডমোর শায়ানি ও এমটি ডাম্বলডোর নামে দুই জাহাজে বন্দরে আনা হয়েছে ২১ হাজার ৫০০ টন সয়াবিন তেল। মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) বন্দর জলসীমায় পৌঁছেছে এমটি সানি ভিক্টরি ও এমটি জিঙ্গা থ্রেশার নামের আরও দুটি জাহাজ। এই দুই জাহাজে রয়েছে ৩০ হাজার ৬০০ টন সয়াবিন তেল। এর মধ্যে এমটি আরডমোর শায়ানি জাহাজ থেকে তেল খালাস শেষ হয়েছে। সোমবারই জাহাজটি বন্দর ছেড়েছে। জাহাজগুলোর মধ্যে সানি ভিক্টরি এসেছে ব্রাজিল থেকে, বাকি তিনটি আর্জেন্টিনা।
জাহাজ কোম্পানি সূত্র জানায়, এই চার জাহাজে সয়াবিন তেল আমদানি করেছে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ বা এমজিআই ও টিকে গ্রুপ। এর মধ্যে টিকে গ্রুপের ২৫ হাজার টন, সিটি গ্রুপের ২০ হাজার টন ও মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ৭ হাজার টন সয়াবিন তেল রয়েছে।
টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার বলেন, সয়াবিন তেলের দাম সমন্বয়ে সরকারের আশ্বাসে এসব সয়াবিন আমদানির জন্য অনেক আগেই ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। এখন মূল্য সমন্বয়ের কারণে আমদানি সামনে বাড়বে। রোজার সময় সয়াবিনের সংকট হবে না। যদিও এখন যেসব জাহাজ আসছে সেগুলোতে টনপ্রতি সয়াবিনের দর ১ হাজার ২১৭ ডলার পড়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি হওয়া এই সয়াবিন তেল প্রথমে জাহাজ থেকে খালাস করে রাখা হবে কাস্টমস নিয়ন্ত্রিত ট্যাংক টার্মিনালে। সেখান থেকে শুল্ক–কর পরিশোধ করে কারখানায় পরিশোধনের জন্য নিয়ে যাবে কোম্পানিগুলো। এরপর পরিশোধন করে বাজারজাত হবে এই সয়াবিন তেল। তাতে এক–দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) এই তেল সংকটের মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ করেছে সরকার।
নতুন দাম অনুযায়ী, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন থেকে বিক্রি হবে ১৭৫ টাকায়, যা এত দিন ছিল ১৬৭ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৫৭ টাকা। দাম পুনর্নির্ধারণের কারণে বন্দরে আসা চার জাহাজের সয়াবিন তেলের বাজারমূল্যও বেড়ে গেছে। যেমন বন্দরে আসা ৫২ হাজার টন তেল পরিশোধন করে বাজারজাত হলে বোতলজাত সয়াবিন হিসেবে বাজারমূল্য দাঁড়াবে ৯৯৬ কোটি টাকা। দাম বাড়ানোর আগে যা ছিল ৯৫০ কোটি টাকা।
এদিকে বাজারে খোলা তেলের দাম বাড়ার কারণে বোতলজাত তেলের এমন সংকট দেখা দিয়েছে বলেও দাবি ব্যবসায়ীদের। কারণ বোতলজাত তেলের চেয়ে খোলা তেলের দাম বাড়তি। তাই বোতলজাত তেল ড্রামে ঢেলে খোলা তেল হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এতেই বোতলজাত তেলের সংকট দেখা দিচ্ছে।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, এখন আগের মতো ডিলারদের কাছ থেকে তেল চাহিদা মতো পাওয়া যায় না। তারা তেল দিচ্ছে স্বল্প পরিমাণে। পুষ্টি, ফ্রেশ, তীরসহ সব কোম্পানি শর্ত দিয়ে তেল সরবরাহ করছে। এক কার্টন তেল নিতে গেলেই তাদের (ডিলার) কাছ থেকে ১ বস্তা দুধ, সুজি, আটা ও চিনি নিতে হচ্ছে। তাদের শর্ত মতো ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে গেলে নানা কথা শুনতে হচ্ছে।
চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি আড়ত খাতুনগঞ্জের এক খুচরা ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোজা এলেই অসাধু সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে যায়। এবারও রমজান আসার আগেই বাজার ধরতে এমন পন্থা। এখন সংকট দেখালে রোজায় বাড়তি দামেই তেল বিক্রি করা যাবে। কারণ তখন তো ভোক্তারা কিনতে বাধ্য। এস আলমের কারখানা তেল বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার কারণেও একটা প্রভাব পড়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের চাহিদার সিংহভাগই এস আলমের তেল। এখন সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অসাধু সিন্ডিকেট সেই বাজার ধরতে চেষ্টা করছে।
রিয়াজ উদ্দিন বাজারের কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী জানান, বাজারে এখন সয়াবিন তেলের সংকট। পাঁচ কার্টন চাইলে এক কার্টন মিলে। সেই সঙ্গে রয়েছে শর্ত; আর শর্ত না মানলে তেলই সাপ্লাই দিচ্ছে না। তারা তেলের জন্য যে শর্ত দিচ্ছে সেসব পণ্য আবার গ্রাহকরা নিতে চান না। তারা না নিলে আমাদের তো কিছু করার নেই। তখন আমাদের তেল নেওয়া বা বিক্রি পোষায় না। আর কোম্পানির শর্ত মানতে গিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়াতে হয়। এখন তারা তাদের টাকা দিয়ে পণ্য কিনবে; সেটা তো একান্তই তাদের ইচ্ছে কোনটা কিনবে বা কিনবে না। এখন আমরা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া মানে ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হওয়া।
আরও পড়ুন: