
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নতুন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসনসহ অন্তত ২২ টি স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। তবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক এসব কাজের মধ্যে জায়গা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্রটি।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশাসনের অবহেলায় পড়ে আছে অতিপ্রয়োজনীয় খাতটি। নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা চিকিৎসা কেন্দ্রটিকে ‘নাপা সেন্টার’ বলে ডাকেন। চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রটি অনেক বছর ধরেই আলোচনা-সমালোচনার বিষয়বস্তু হলেও ভ্রুক্ষেপ নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র হিসেবে এই চিকিৎসা কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখান থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন। তবে উদ্বোধনের ১০ বছর পরেও চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে চৌকস জনবল, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নেই।
চিকিৎসাকেন্দ্রটি উদ্বোধনের পর ৪ তলা পর্যন্ত বর্ধিত করার কথা থাকলেও অবকাঠামোগত সংকটের জন্য এখনো ১ তলা ভবনেই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে নেই কোনো বেড। ৬ টি অবজারভেশন টেবিল আছে। এই টেবিল গুলোতেই রোগীদের চিকিৎসা হয়। ফলে বিভিন্ন সময় এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদুজ্জামান বলেন, আমরা যারা এখানে সেবা নিতে আসি, তাদের বেশিরভাগই এখানকার চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট না। সবসময় ডাক্তার থাকেন না, প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেই। অনেক বছর ধরেই এমন চলছে কিন্তু উন্নয়নের কোন নাম-গন্ধ নেই।
চিকিৎসা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে চিকিৎসা কেন্দ্রে স্থায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা ৯ জন। তাদের মধ্যে ৬ জন পুরুষ এবং ৩ জন মহিলা। তাছাড়া খণ্ডকালীন চিকিৎসক আছেন ১ জন। রাত্রিকালীন এবং ছুটির দিনে সেবা দিতে ১০ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এই চিকিৎসকগণ প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক (সাধারণত ৩৮ টি) ডিউটি করে থাকেন। চিকিৎসা কেন্দ্রে সেবাদানের দায়িত্বে থাকা সকল চিকিৎসক এমবিবিএস ডিগ্রীধারী। তবে এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ কোন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে। চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে কোন নার্স নেই। ২ জন মহিলা এইড নার্স এবং ২ জন পুরুষ এইড নার্স এর সাথে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে ১ জন পুরুষ এইড নার্স বর্তমানে কর্মরত আছেন। ফার্মেসির দায়িত্বে থাকা ফার্মাসিস্টের সংখ্যা ২ জন (স্থায়ী)। টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে স্থায়ী দায়িত্বে আছেন ৪ জন।
রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স সংকট:
রোগী পরিবহনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫ টি এম্বুলেন্স বরাদ্দ দেওয়া আছে। এর মধ্যে সচল আছে মাত্র ৩ টি। যার মধ্যে ২ টি চিকিৎসা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে এবং ১ টি ভিসি অফিসের নিয়ন্ত্রণে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ২ টি এম্বুলেন্স কোনোভাবেই পরিপূর্ণ সেবা দিতে পারেনা। প্রায় শিক্ষার্থীদের এম্বুলেন্সের জন্য ভোগান্তি পড়তে হয়।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের কর্মরত এক চিকিৎসক জানান, প্রশাসনের সর্বোচ্চ বৈষম্যের শিকার এই মেডিকেল সেন্টার। আমাদের বাজেট বাড়ে না। প্রতিবার দেখানো হয় যে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আসলে বৃদ্ধি করা হয় ডাক্তার, কর্মচারীদের বেতন। বেতন বৃদ্ধি করলে তো চিকিৎসা সেবা নিতে আসা মানুষদের সুবিধা বাড়বে না। কারণ প্যাথলজি বিভাগ বা ওষুধের জন্য কোন বাজেট থাকে না তেমন। মেডিকেল সেন্টারে যে ইসিজি মেশিন, অক্সিজেন সিলিন্ডার, বসার জন্য স্টিলের চেয়ার এগুলোও প্রশাসন থেকে আসেনি। এসব আমরা এনেছি ডোনেশনের মাধ্যমে।
এ বিষয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. শামসুর রহমান বলেন, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে ৩ টি। অবকাঠামো, জনবল এবং বাজেট। এসব নিয়ে আমি ইতিমধ্যে কয়েকবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবগত করেছি। তারা আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে অতিদ্রুত এসব সমস্যা দূরীকরণের জন্য ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের অসুবিধা নিয়ে তারাও চিন্তিত।
এসব সংকটের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের পরামর্শক কমিটির সভাপতি এবং উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হয়ে আমাদের চিকিৎসা কেন্দ্রের জন্য যে বাজেট আসে সেটা পর্যাপ্ত নয়। আমাদের ঔষধ, রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট এগুলোর সংখ্যা এবং কর্মরত জনবল, নার্স, ডাক্তার এবং অন্যান্য স্টাফদের সংখ্যা ৫৩ বছর বয়সী এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এসব বিবেচনায় চিকিৎসা কেন্দ্রের যে উন্নয়ন হওয়া প্রয়োজন ছিলো তা হয়নি। আমরা নানাভাবে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প করেছি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের জন্য কোন বরাদ্দ আনা হয়নি। আমি মনে করি, আমাদের যে উন্নয়ন প্রকল্প ছিলো সেখানে যদি চিকিৎসা কেন্দ্রটি যুক্ত থাকতো তাহলে চিকিৎসা কেন্দ্রের ফিজিক্যাল রিসোর্স, টেকনিকাল রিসোর্স, হিউম্যান রিসোর্স আরো বৃদ্ধি পেত। এখন আমরা দায়িত্ব নিয়েছি, দায়িত্ব নিয়ে আমাদের যেই সীমিত সম্পদ, মানব সম্পদ এবং রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যে কিট কিংবা ঔষধ, এগুলো আমরা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছি।
আরও পড়ুন: