
জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন, সবার প্রত্যয় জোরালো থাকলে জটিল পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বকে বিরাট আশাবাদের গল্প শোনানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা গ্রহণ করে সেটা কাজে লাগাতে সবার সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা উচিত।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়ে আন্দোলনকারী ও এর সমর্থকদের ওপর গুরুতর অপরাধ করেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। আন্দোলন দমন করে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের অপরাধ করেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সদস্য, সরকারের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী সদস্যরা। বাংলাদেশে অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতিবেদন জেনেভা থেকে গত ১২ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয়। গতকাল (বুধবার) আলোচনায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়ায় সুবিচার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন।
আলোচনার শুরুতে ভলকার তুর্ক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এরপর বক্তৃতা করেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
আলোচনায় ভলকার তুর্ক ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও দলটির সদস্যদের নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার কথা উল্লেখ করেন। পদক্ষেপ হিসেবে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়টি তুলে ধরেন ভলকার তুর্ক।
তিনি বলেন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ (আইসিটি) বাংলাদেশের আদালতে অনেক মামলা করা হয়েছে। তবে এসব মামলায় সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বাইরেও ক্ষত নিরাময়, সত্য বলা, পুনর্মিলন, জুলাই-আগস্ট স্মরণ ও সংস্কারের মতো বিষয়গুলোতে জোর দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। হাইকমিশনার বলেন, এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের জন্য অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি বড় সুযোগ এসেছে।
তুর্ক বলেন, ‘ধর্মীয় বা জাতিগত নিজেদের মধ্যে যে মতানৈক্যই থাকুক না কেন, বাংলাদেশ একটি দেশ, সবারই নাগরিকত্ব বাংলাদেশি। আমার মনে হয়, সংস্কার চেষ্টার মাধ্যমে এখন এ চেষ্টাই চলছে। ফলে আমাদের সবাইকে সংস্কার কার্যক্রমকে সহযোগিতা করতে হবে।’ এ প্রেক্ষাপটে তিনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকারকে সংযুক্ত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলেও আশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, এটি সব বাংলাদেশির জন্য একটি বিরল সুযোগ, তারা যে গ্রুপ বা কমিউনিটিরই হোক না কেন। এটাই মানবাধিকার দৃষ্টিকোণে একটি বড় আশা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের চ্যালেঞ্জটা বেশ কঠিন। তবে সব রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়সহ সবার প্রত্যয় জোরালো থাকলে জটিল পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বকে বিরাট আশাবাদের গল্প শোনানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।
অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশ জুলাই-আগস্ট গণহত্যার নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়ার জন্য আইসিটি আইনটি ইতোমধ্যে সংশোধন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টার বক্তব্যের শেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের চালানো মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বলপ্রয়োগের ভিডিও তথ্যচিত্র উপস্থাপন করা হয়।
জুলাই-আগস্টে আহত ব্যক্তিদের সহায়তাকারী স্বেচ্ছাসেবী ও স্থপতি ফারহানা শারমিন ইমু সে সময়কার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। আর গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান ভাই হারানোর বিচারের দাবি জানান।
ফারহানা শারমিন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য অপরিহার্য বিষয়টি হচ্ছে, প্রথমেই শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের যথাযথভাবে চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের বিচার করা দুটিই পাশাপাশি চালিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়।
মীর মাহমুদুর রহমান বলেন, যারা ট্রিগারে আঙুল চেপেছেন শুধু তারাই নন, যারা গুলি করার নির্দেশদাতা ছিলেন তাদের বিচার করতে হবে।ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি।
নির্ধারিত আলোচকদের বক্তব্যের পর উপস্থিত ব্যক্তিরা তাদের প্রশ্ন করেন।
বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতিবেদন জেনেভা থেকে গত ১২ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের সহিংস কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ছিল। ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা সরকার ক্রমাগত নৃশংস পদক্ষেপ নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছিল। বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই গুলিতে নিহত হন।
আরও পড়ুন: