শুক্রবার

১৮ এপ্রিল, ২০২৫
৫ বৈশাখ, ১৪৩২
২০ শাওয়াল, ১৪৪৬

হাসিনাকে স্বৈরাচার বললেন আওয়ামী লীগের দোসর তুরিন আফরো

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০ এপ্রিল, ২০২৫ ২১:৪৯

শেয়ার

হাসিনাকে স্বৈরাচার বললেন আওয়ামী লীগের দোসর তুরিন আফরো
আওয়ামী লীগের দোসর তুরিন আফরো

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। এক সময়ের আলোচিত আইনজীবী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রসিকিউটর এবং নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা এই নারী বর্তমানে বিতর্ক, অভিযোগ আর রাজনৈতিক পল্টিবাজির এক জ্বলন্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার’ বলে বক্তব্য দিয়ে আলোচনা সমালোচনার তুঙ্গে উঠে আসা এই ব্যারিস্টারের অতীত ও বর্তমানের বিপরীতমুখী অবস্থান প্রশ্ন তুলছে সর্বমহলে ।

বিস্তারিত: https://www.youtube.com/watch?v=kM3b4il2fe8

গত সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে তুরিন আফরোজকে আটক করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী আব্দুল জব্বারকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুমন মিয়া তাঁর ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানির সময় কোনো আইনজীবী না থাকলেও আদালতে নিজেই নিজের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তুরিন।

তুরিন বলেন, “তিনি চার বছর ধরে মিডিয়ায় কিছু বলেনি। তিনি চাকরি থেকেও ছয় বছর বঞ্চিত। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।” তিনি আরও বলেন, “তারা চাইলে তাঁকে ২০ দিনের রিমান্ডে নিতে পারেন, তিনি তদন্তে সহযোগিতা করবেন।”

হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বললেও তুরিন আফরোজ গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাঁর মোবাইল ও ল্যাপটপ জব্দ করলে সেখানে উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য । তুরিনের সোস্যাল মিডিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো এবং হাসিনার গুণগান করার প্রমাণ পায় পুলিশ ।

তুরিন আফরোজ যিনি এক সময় আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবী ও ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউটর হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনি আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিলেন। এই মন্তব্য শুধু বিস্ময়ের জন্ম দেয়নি, বরং তার অতীত অবস্থানের সঙ্গে এক ধরনের স্পষ্ট দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।

তুরিন আফরোজ এক সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে তাঁর নিয়োগ প্রমাণ করে, তিনি সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন। সেই সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তাঁর তৎপরতা এবং গণজাগরণ মঞ্চ ও ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সদস্য সচিব হিসেবে তাঁর সম্পৃক্ততা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল আইকন হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

তবে এই জনপ্রিয়তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে ইসলামবিদ্বেষের অভিযোগ। তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে ১১৬ জন আলেমের একটি তালিকা জমা দেন, যাদের বিরুদ্ধে তিনি ‘ধর্মব্যবসা ও জঙ্গি অর্থায়নের’ অভিযোগ আনেন। তালিকাটিকে অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যা দিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। ইসলামী দলগুলোসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন তাঁকে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ আখ্যা দেয়। তাঁর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয় যে, তিনি আলেম সমাজকে হয়রানি করার জন্য সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে কাজ করছেন।

তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে অভিযোগ থেমে থাকেনি কেবল ধর্মীয় বিদ্বেষে। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে যুদ্ধাপরাধী সন্দেহভাজনের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে ২৫ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ। যদিও ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায় এবং কোনো আনুষ্ঠানিক তদন্ত হয় না, তবে গণমাধ্যমে এই খবর আলোচনার ঝড় তোলে।

এছাড়া, তাঁর ব্যক্তিজীবনেও কলহের শেষ ছিল না। কথিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা মণ্ডলীর সভাপতি শাহারিয়ার কবিরের সাথে ছিল গভীর সখ্যতা। কবিরসহ অনেকের সাথে লিপ্ত হতেন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।  তুরিনের মা ও ভাই সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, তুরিন নিয়মিত মদ্যপান, জুয়া ও অনৈতিক আসরের আয়োজন করতেন। এমনকি, নিজের মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগে আলোড়ন তৈরি হয়। এই সব ঘটনা একত্রে তুরিন আফরোজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে দেয় এবং তাঁকে সমাজ ও পরিবার থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরই দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। এক সময়ের সরকারের ঘনিষ্ঠ তুরিন আফরোজ নিজেকে বঞ্চিত, অবহেলিত এবং এমনকি শোষিত দাবি করতে শুরু করেন। হাসিনার সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলার মতো সাহসিকতা তখনই আসে যখন সেই সরকার আর ক্ষমতায় নেই। এর আগে তিনি সবসময় সরকারের পক্ষে টকশোতে, কলামে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে অবস্থান নিয়েছেন।

তাঁর এই অবস্থান হঠাৎ পরিবর্তনের ঘটনাকে সাধারণ মানুষ দেখছেন নিছক পল্টিবাজি হিসেবে। অনেকেই বলছেন, নিজের অপকর্ম ও ব্যর্থতা ঢাকতেই তিনি এখন সরকারবিরোধী সুরে কথা বলছেন। অতীতে তিনি যাদের ‘জঙ্গি’ বলে দোষারোপ করেছেন, আজ তাঁদের পক্ষেও পরোক্ষভাবে সহানুভূতি প্রকাশ করছেন। এটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী আচরণ।

তুরিন আফরোজ নিজেকে একজন আইনের শিকার, গণতন্ত্রের সৈনিক এবং নির্যাতিত নারীরূপে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁর অতীতের কর্মকাণ্ড, বক্তব্য এবং অবস্থান বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি মূলত সব সময় নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যখন তিনি সরকারঘনিষ্ঠ ছিলেন, তখন বিরোধীদের দমন এবং আলেমদের বিরুদ্ধে তিনি সরব ছিলেন। আর এখন সরকার ক্ষমতাচ্যুত, তখন নিজেকে সেই সরকারের ‘শিকার’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ মনে করছেন, তুরিন আফরোজের বক্তব্যে কোনো আদর্শগত অবস্থান নেই। এটি নিছক রাজনৈতিক পল্টিবাজি। আলেমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ঘুষ কেলেঙ্কারি, পারিবারিক নির্যাতন এবং এখন আবার ভিকটিম সেজে আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি, সব মিলিয়ে তাঁর চরিত্রে দ্বিমুখিতা স্পষ্ট।

ব্যারিস্টার সুমনের মতো তুরিন আফরোজকেও জনগণ  বিচার দাবি করছে। অনেকে বলছেন, এই ধরনের পল্টি নেতানেত্রীদের কারণেই দেশে গণতন্ত্র বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

তবে, তুরিন একা নয় । বিভিন্ন ঘটনার সূত্র বলা যায় ইসলাম বিদ্বেষীদের একটি চক্র রয়েছে যারা সংঘবদ্ধ ভাবে ইসলাম ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করছে । এই চক্রে নাস্তিক তাসলিমা নাসরিন, শাহারিয়ার কবির সহ অনেকেই রয়েছেন । তুরিন আফরোজকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর থেকে বাদ দেয়ার পর তাঁর পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করে শাহারিয়ার কবির।

আবার শাহারিয়ার কবিরকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তাঁর সাফাই গাওয়া শুরু করে নাস্তিক তাসলিমা নাসরিন ।

ইসলামবিদ্বেষীদের এমন একে অপরের পাশে দাঁড়ানোকে হাল্কা ভাবে দেখার সুযোগ নেই। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তাসলিমা নাসরিন, তুরিন আফরোজ, শাহারিয়ার কবির একই সুতোয় গাঁথা। আর এর সাথে কাজ করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র ।

তুরিন আফরোজের বর্তমান অবস্থান রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, বরং আত্মরক্ষার প্রয়াস। এক সময়ের ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী আইকন এখন পরিণত হয়েছেন এক বিতর্কিত, নিঃসঙ্গ চরিত্রে। তাঁর ফ্যাসিস্ট মন্তব্য নিছক প্রতিশোধের ভাষা, আর নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা মাত্র, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষ।

 

 

banner close
banner close