
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও তা নির্মূলে বিগত সরকারের সফলতা বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে মাঝে মধ্যেই জঙ্গি নাটক মন্তস্থ করতেন পতিত শেখ হাসিনা সরকার। প্রশাসনের মাধ্যমে মাদ্রাসাছাত্র,মসজিদের ইমাম এবং ৫ওয়াক্ত নামাজিদের মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করে জঙ্গি তকমা দেয়া হত আওয়ামী শাসনামলে।
পতিত শেখ হাসিনার আমলে জঙ্গি বলতে বোঝানো হত দাড়ি টুপি ও নামাজিদের। এছাড়াও যুবক বয়সে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠা, ৫ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা,গান বাজনা অপছন্দ করা, অসৎ সঙ্গে না মিশে নিজের মত থাকাসহ বিভিন্ন ইতিবাচক দিকগুলোকে জঙ্গিবাদের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল সেসময়। প্রশাসন মাঠ পর্যায়ে এই লক্ষণগুলো সনাক্ত করে ধার্মিক মুসলমানদের জঙ্গি বলে গ্রেফতার করতেন। আর ধার্মিক মুসলমানদের সঙ্গে জঙ্গিবাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বিদ্যাপিঠেও শিক্ষার্থীদেরও এমনটাই শেখানো হত।
বাংলাদেশের জঙ্গিরা সবসময় নাটকীয়ভাবে জাতীয় নির্বাচনের আগে মাথাচাড়া দিত। জাতীয় নির্বাচনের আগে জঙ্গি নিধনের নাটক মন্তস্থ করে বহির্বিশ্বের নজরে পতিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা নিজের সফলতা তুলে ধরতেন। জঙ্গি নাটক মন্তস্থ করতে গিয়ে অসংখ্য নিরীহ মুসলমানদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হত সেসময়। ইসলাম ধর্মের রীতিনীতিতে অটল থাকা মানুষদের গ্রেফতার করে জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করা হত। জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা অথবা নাশকতামুলক কার্যক্রম সংগঠনের পরিকল্পনা করার অপরাধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা দিয়ে তাদের নিকট থেকে উদ্ধার দেখানো হত অস্ত্র,গুলি,জিহাদী বই।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও সারাদেশে জঙ্গি নিধন করতে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযান করতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। তবে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি নাশকতা মামলার নথি আসে বাংলা এডিশনের ঠিকানায়। বাংলা এডিশনের অনুসন্ধানী দল জি আর- ৩৭২/২০১৮ নম্বর মামলায় কারাবন্দি মানুষগুলোর পরিবারের সাথে কথা বললে নির্মম হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো বলতে থাকে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
জি আর ৩৭২/২০১৮ নম্বর মামলায় মোট ৫ জনকে আসামি করা হয়। যাদের সকলেই ২০১৮ সাল থেকে আজ অবধি কারাবন্দি আছেন। মামলার ১ ও ৪ নম্বর আসামি হাসান আলী ও আবু নাইম লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে। বৃদ্ধ জাহাঙ্গীর আলমের দুইজন ছেলে কারাগারে বন্দি আছে ২০১৮ সাল থেকে। জাহাঙ্গীর আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানায় স্থানীয় আকিজ ফ্যাক্টরীতে শ্রমিকের কাজ করতেন তার দুই ছেলে। একই সাথে দুই ছেলেই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। আকিজের ফ্যাক্টরীতে কর্মরত অবস্থায় তার ছেলে সহ এই মামলার অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে মামলায় ঘটনাস্থল দেখানো হয় মুশরত মাদাতী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।
আকিজ ফ্যাক্টরী থেকে যেসময় প্রশাসন এই মামলার আসামিদের গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তখন প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাক্ষীর কথা জানায় জাহাঙ্গির আলম। দুখু মিয়া নামের ওই ব্যক্তি এই মামলায় আদালতেও সাক্ষী দিয়েছেন।
মামলার ওই সাক্ষীর নাম দুখু মিয়া। তার কাছে ওইদিনের ঘটনা জানতে চাইলে তিনি ঘটনার বর্ননা দেন। তার দেয়া তথ্যমতে আসামিদের গ্রেফতার করার সময় তাদের নিকট থেকে কিছুই উদ্ধার করা হয়নি।
তবে দুখু মিয়া আদালতে আসামীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছেন বলে বাংলা এডিশনের কাছে তথ্য আছে। যেকারণে আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দেয়ার কারন দুখু মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি তার সাথে ঘটে যাওয়া আরেক অবিচারের কথা জানায় বাংলা এডিশনকে। যেটি শুনে মনে হয়েছে মিথ্যা ঘটনায় আসামী করে যাদের সাথে অবিচার করা হয়েছে, তার থেকেও বেশি অবিচার করা হয়েছে দুখু মিয়ার সাথে। মিথ্যা সাক্ষী দিতে না চাওয়ায় তাকেও ৭৬ দিন কারাবন্দি রাখা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
জাহাঙ্গীর আলম ও সাক্ষী দুখু মিয়ার দেয়া তথ্যমতে ওই মামলার ৫ জন আসামীকে ভোটমারী আকিজ ফ্যাক্টরি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তবে গ্রেফতারের সঠিক কারণ সম্পর্কে জানতেন না উপস্থিত কেউ। ওই মামলায় কারাবন্দি অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে টিম বাংলা এডিশন।
মামলার ৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে শফিউল ইসলাম সাদ্দাম নামের একজন ব্যক্তিকে। মামলার এফ,আই,আর’এ সাদ্দামের বয়স দেখানো হয়েছে ২৪ বছর। তবে সাদ্দামের মায়ের সাথে কথা হলে তিনি জানায়, তার ছেলে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার ৭ম শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন। তার বয়স ১৩/১৪ বছরের বেশি না। মাদ্রাসায় পড়ালেখা করার পাশাপাশি আকিজ ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করে পরিবারের ব্যয় চালাত সাদ্দাম। সাদ্দাম কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সাদ্দামের মা।
জাহাঙ্গীর আলমের দুই ছেলে হাসান আলী ও আবু নাইম এবং শফিউল ইসলাম সাদ্দাম এরা সকলেই মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন বলে পরিবারের দেয়া তথ্যমতে জানা যায়। সেই সাথে সকলেই আকিজ ফ্যাক্টরিতে কাজ করে পরিবারের ব্যয় চালাত। মামলার বাকী দুইজন আসামি আসমত আলী ও আলী হোসেনও এলাকায় নম্র ভদ্র এবং ধার্মিক হিসেবে পরিচিত। মামলার যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের সকলেই দরিদ্র পরিবারের কঠোর পরিশ্রমী এবং ধার্মিক হিসেবে পরিচিত তাদের নিজ নিজ এলাকায়।
এই মামলা ছাড়াও লালমনিরহাটের ওই উপজেলায় বেশ কিছু মানুষকে কথিত নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করে গ্রেফতার করা হয়েছিল ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে। অনেককে গ্রেফতারের পর মধ্যযুগীয় সময়ের মত নির্যাতন করে দোষ স্বীকার করতে বাধ্য করা হায়েছে বলে অভিযোগ আছে।
নাশকতা ও অস্ত্র আইনের মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দি থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন মেহেদী সাদ্দাম সবুজ। তিনি নিজ এলাকায় পারিবারিক মসজিদের ইমামতি করতেন। তাকে জঙ্গি প্রমাণ করতে র্যাব বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। পরে নির্মম নির্যাতন শেষে অস্ত্রসহ গ্রেফতার দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে নাশকতা আইনে মামলা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
রংপুর র্যাব ১৩ কার্যালয়ে নিয়ে তাকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এছাড়াও লালমনিরহাটে বিভিন্ন সময় প্রশাসন নাশকতা ও অস্ত্র আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন তাদের মধ্যে কেহই এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাস নয়। সকলেই মাদ্রাসার বর্তমান ও সাবেক ছাত্র এবং মসজিদের ইমাম। শান্তির ধর্ম ইসলামের সাথে আওয়ামীলীগের শত্রুতা কোথায় সেটার উত্তর অজানা তবে এলাকার ধার্মিক মানুষদের নামের তালিকা করে দিতেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা। আওয়ামী শাসনামলের পুরোটা সময় জুড়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ছিল বাংলাদেশের ধর্মপ্রান মুসলমানেরা।
আরও পড়ুন: