
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর... জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই আহ্বানকে ধারণ করেই বছর ঘুরে আবার এসেছে পহেলা বৈশাখ। বাংলা নতুন বছর। নতুন সূর্যের আভায় বিচ্ছুরিত আলোকণা দুলে ওঠে হৃদয়ে। গাছে নতুন পাতা যোগ করার মতোই আমাদের মনকে নতুন করে বৈশাখ। নির্লিপ্ত আকাশ চুইয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহ যখন জীবন মরুময় করে, চৈতালী রোদে যখন কাদামাটি ঠনঠনে, মাঠে-ঘাটে কৃষক-কৃষাণীর যখন নাভিশ্বাস, তখনই বৈশাখ আনে ঝড়। সেই ঝড় শুষ্ক পাতা ঝরিয়ে দেয়। নবীন জন্মকে ত্বরান্বিত করে। বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের দুঃশাসন থেকে দেশকে নতুন প্রজন্মমুক্ত করে নবযাত্রা শুরু করেছে। তাই এবারের বর্ষবরণ উদযাপনে তারুণ্যের উদ্দীপনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এবারের বর্ষবরণ বাংলাদেশের সকল নাগরিক, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কাছে অন্যরকম এক উৎসবের আবহ তৈরি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই প্রথমবারের মতো দেশের সকল নাগরিক, সকল সম্প্রদায় ও নৃগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে আজ সর্বজনীন লোকউৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন করছে।
পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ সেজে উঠেছে নতুন সাজে, নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। বাঙালি জাতির শাশ্বত ঐতিহ্যের প্রতীক এ দিনটি উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার বাণীতে বলেন, ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থান বৈষম্যহীন, সুখী-সমৃদ্ধ, শান্তিময় ও আনন্দপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের প্রেরণা দেয়। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই হোক এই বাংলা নববর্ষে আমাদের অঙ্গীকার। আসুন, আমরা বিগত বছরের গ্লানি, দুঃখ-বেদনা, অসুন্দর ও অশুভকে ভুলে গিয়ে নতুন প্রত্যয়ে, নতুন উদ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে চলি।
এছাড়া বাণী দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তারেক রহমান তার বাণীতে বলেন, জাতির আত্মপরিচয়ে পহেলা বৈশাখ এক উজ্জ্বল উপাদান। বাংলাদেশি জাতিসত্তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নববর্ষ উদযাপন। বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশিদের হৃদয়ে তার প্রকাশ অনন্য ভিন্নরূপ। আমি এই উৎসবমুখর দিনে দেশ-বিদেশে অবস্থানরত সকল বাংলাদেশিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এবারের পহেলা বৈশাখে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা ও বিভাজন দূর হবে। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ফ্যাসিস্টদের পতনের পর এবারের পহেলা বৈশাখ স্বস্তির বাতাবরণে উদযাপিত হবে। তাই আমি বিশ্বাস করি, মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা ও বিভাজন দূর করে পহেলা বৈশাখের উৎসব ভরে উঠবে পারস্পরিক শুভেচ্ছায়।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, সরকার প্রথমবারের মতো ১৪৩২ সালের বাংলা নববর্ষ এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং গারোসহ অন্য নৃ-গোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে।
বছরের প্রথম দিনটিকে আরো উৎসবমুখর করে তোলে শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলা। এগুলো মূলত সর্বজনীন লোকজ উৎসব। বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক গ্রামীণ বৈশাখী মেলাগুলোতে মেলে স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সর্বপ্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী, খেলনা এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমনÑচিঁড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারোহ। আরো থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, যাত্রা, লোকজ গানের আসরসহ নানান বিচিত্র বিনোদন।
সরকারের নেয়া কর্মসূচি অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, মহানগর ও পৌরসভা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তিন পার্বত্য জেলা এবং অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দলগুলোর শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের সমন্বয় করবে। পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে ভোরে রমনা বটমূলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক), বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাংলাদেশ লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও বর্ষবরণ উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বর্ষবরণের ঐতিহ্য অব্যাহত রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উৎসবমুখর পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ বের করবে। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ এই প্রতিপাদ্য শুরু হবে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। নতুন বর্ষবরণ উপলক্ষে দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। বিপুলসংখ্যক অতিথির সমাগম উপলক্ষে দেশবাসীর উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু- পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও পুরো ঢাকা শহরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শাহবাগ, রমনা পার্কসহ বিভিন্ন এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা, আর্চওয়ে গেইট, হেল্প ডেস্ক, কন্ট্রোল রুম, অস্থায়ী পাবলিক টয়লেট এবং অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পসহ নেয়া হয়েছে নানা ধরনের ব্যবস্থা। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের এবারের মূল বার্তা আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। আলো, প্রকৃতি, মানুষ দেশপ্রেমের গান।
আরও পড়ুন: