
২০১৬ সালের ২৫ জুলাই। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার কল্যাণপুরের পাঁচ নম্বর সড়কে জাহাজবাড়ী নামে পরিচিত একটি ভবণে জঙ্গি অভিযান পরিচালনা করে তাদের একটি দল। এতে, পাল্টাপাল্টি গোলাগুলিতে নিহত হয় ৯ তরুণ। তবে, পাল্টাপাল্টি গোলাগুলির কথা বলা হলেও, অভিযানে অংশ নেয়া কোনো পুলিশের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, নিহত হয়েছেন শুধুই ওই নয়জন তরুণ।
বিস্তারিত: https://www.youtube.com/watch?v=s8h2VEuGCI8&t=37s
সেসময়ে, পুলিশের ওই অভিযান নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহলে। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, নিহতদের মধ্যে কারো কারো হাতে ফল কাঁটার ছুড়ি দেখা গেছে। গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার পরও কীভাবে হাতে ছুড়ি ধরে রাখলো তারা? এ ছাড়া, পুলিশের গুলির সামনে, ছুড়ি কীভাবে প্রতিহতের অস্ত্র হতে পারে? অনেকের বোধ্যগম্য হয়নি সেটিও।
জাহাজবাড়িতে পুলিশের ওই অভিযান নিয়ে গত ডিসেম্বরে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক আমার দেশ। একজন হুইসেলব্লোয়ারের মাধ্যমে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, জঙ্গি দমনের নামে সেদিন নাটক সাজায় পুলিশ। আর পুলিশের এই অভিযানের বিশ্বস্ততা তৈরি করতে, ব্যবহার করা হয় দেশের নামধারী কয়েকটি গণমাধ্যমকে।
সম্প্রতি, এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হত্যাযজ্ঞের অভিযোগে সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক, সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সেই মামলায় কারাগারে রয়েছেন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা।
জাহাজবাড়ির এই জঙ্গি নাটক নিয়ে বাংলা এডিশনকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আসামীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত দেব রানা। সাক্ষাৎকারে তিনি এই মামলার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে, এটিকে পুলিশের সাজানো নাটক বলে দাবি করেন।
তবে, কল্যাণপুরের জাহাজবাড়িতে অভিযানের ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল পুলিশবাদী ওই মামলার ৮ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনালের বিচারক আব্দুল হালিম। একদিকে, রাষ্ট্রপক্ষ এই ঘটনায় সাজানো নাটকের জন্য জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে, অন্যদিকে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনালের বিচারক, শেখ হাসিনার আমলে করা পুলিশের মামলায়, আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারিক কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার। সেটিও, পুলিশের আগের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, নতুন বাংলাদেশে ন্যায় বিচারের স্বার্থে আইনগতভাবে বিকল্প কোনো সুযোগ কি ছিলো বিচারকের সামনে?
বিডিআর, শাপলা হত্যাকাণ্ডসহ বিচারবহির্ভূত বিভিন্ন হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে প্রশ্নবিদ্ধ পতিত শেখ হাসিনার সরকার। এছাড়া, আয়নাঘরে বন্দী রেখে নির্যাতন, জঙ্গি নাটক সাজানোসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে। আর তার এসব নির্দেশ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেছে শহিদুল, আছাদুজ্জামানের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তারা। যেহেতু, জাহাজবাড়ির ঘটনা হাসিনার পালিত পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তাই তাদের সাজানো মামলার পুনঃতদন্ত চাইতেই পারতো, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। কারণ, হাসিনার পতনের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের পথ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে।
রাষ্ট্রপক্ষের একটা অংশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জাহাজবাড়ির ঘটনায় মামলা করেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের আরেকটা পক্ষ ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনালে পুলিশের করা ওই মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে বিচারকের অভিযোগ গঠনের যুক্তির পক্ষে থাকায়, ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে জনমনে।
একইভাবে, বিচারকের দেয়া নির্দেশ নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়েছে চারদিকে। যদিও, আইনগত দিক থেকে জাহাজবাড়ির ঘটনায় পুলিশের করা মামলায়, অভিযোগ গঠনে বিচারকের কোনো বাঁধা নেই। তবে, শেখ হাসিনার আমলে পুলিশবাদী মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে, পূর্বের চার্জশিটে থাকা বর্ণনা হুবহু রেখে অভিযোগ গঠন করায়, বিচারকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। কারণ, বিচারক চাইলে, চার্জশিটে থাকা ঘটনার ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন তদন্তকারী পুলিশের কাছে।
আসামীপক্ষের আইনজীবীরা আরো জানান, সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনাল জাহাজবাড়ীর ঘটনায় ৮ জনের বিরুদ্ধে ৬ এর ২ ধারায় চার্জ গঠন করেছে। ৭ এপ্রিল আদালতে উপস্থিত ছিলেন ৭ আসামী। ওইদিন চার্জ গঠনের জন্য আদালতে হাজির করা হয় তাদের। আসামীদের পক্ষে শুনানিতে জানানো হয়, এই ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। বিচারক তখন জানান, বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন তিনি। বিভিন্ন যুক্তি শোনার পর আসামীপক্ষের অব্যাহতির আবেদন না মঞ্জুর করেন বিচারক আব্দুল হালিম।
এ ছাড়া, শুনানির সময়, হাসিনার আমলের ওই ঘটনা নিয়ে সেসময়ে গণমাধ্যমের করা সংবাদ, স্ক্রিনে ছাড়তে বলেন বিচারক। ওই সময়কার সংবাদ দেখা শেষ হলে, আসামীপক্ষের আইনজীবীরা, জাহাজবাড়ির জঙ্গি নাটক নিয়ে গণমাধ্যমে আসা সাম্প্রতিক সংবাদ ছাড়তে বললে, নিষেধ করেন বিচারক আব্দুল হালিম।
একইসঙ্গে, জঙ্গি নাটকের জন্য ওই সময়ে বিভিন্ন মিডিয়াও দায়ী ছিলো বলে মনে করেন এই আইনজীবী। ফলে, সেই সময়কার নিউজের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য তার।
কল্যাণপুরের ওই ঘটনাকে নাটক উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট সুব্রত দেবনাথ রানা বাংলা এডিশনকে আরো বলেন, হোলি আর্টিজান আর জাহাজবাড়ির ঘটনা একইভাবে সাজানো হয়েছে। আসামীদের থেকে নেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দীও বানানো বলে মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।
এদিকে, সেই অভিযানে নিহত সাতক্ষীরার তরুণ মতিউর রহমানের বাবা নাসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে বাংলা এডিশন। ঘটনার পর, পুলিশের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার আদালতে মামলা করতে গেলেও, মামলা নেয়নি আদালত। ছেলের মৃতদেহও দেয়া হয়নি মতিউরের বাবাকে। অভিযানে নিহত ৯ জনের কারো মরদেহওই পরিবারকে দেয়নি পুলিশ। মৃতদেহগুলো দিয়ে দেয়া হয় বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী ও জনকল্যাণ সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে। জানাজা না করতে পারার এই কষ্ট নিয়ে, মতিউরের বাবা জানান জঙ্গি ছিলো না তার ছেলে। ইসমালিক আদর্শিক হওয়ায়, গুমের পর জাহাজবাড়িতে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় মতিউরকে।
এছাড়া, এই মামলার আসামী রাকিবুল হাসান রিগ্যানের মায়ের সঙ্গে কথা বলে বাংলা এডিশন। ঘটনাস্থলে যাকে পায়ে গুলি করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে পুলিশ। শিবিরপ্রধান এলাকায় বসবাস করায় রাকিবকে জঙ্গি বলে উঠিয়ে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাকিবের মা অভিযোগ করেন, জাহাজবাড়ির ঘটনার অনেক আগেই তার ছেলেকে সাদা পোশাকে তুলে নেয় পুলিশ। তাহলে, বন্দী বা গুম থাকা অবস্থায় কল্যাণপুরে কীভাবে গেলেন রাকিব? এমন প্রশ্ন তোলেন তোলেন তিনি।
মামলার আরেক আসামী শরীফুল ইসলামের ছোট ভাই আরিফুল ইসলামও বাংলা এডিশনকে জানান, ভারতে ঘুরতে গেলে দিল্লি পুলিশ গুম করে তার ভাইকে। নিয়মিত নামাজ পড়তেন বলে তাকে সন্দেহ করতেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনিও একই প্রশ্ন ছুড়ে দেন, গুম থাকা অবস্থায় তার ভাই কীভাবে জড়িত থাকতে পারেন জাহাজবাড়ির ঘটনায়?
২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাহাজবাড়ি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ১০ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। পরে, মামলাটি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বদলির আদেশ দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস।
পুলিশের সাজানো এই মামলা থেকে আসামীদের দ্রুত অব্যাহতির দাবি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর। একইসঙ্গে, নতুন বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের স্বার্থে রাষ্ট্রপক্ষের সমর্থন আশা করেন তারা। সেইসাথে, প্রকৃতঅর্থে ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি সবার। দেশকে অস্থিতিশীল করতে আর কাউকে জঙ্গি নাটকের সুযোগ দেয়া হবে না, এমন প্রত্যয় সাধারণ মানুষের।
আরও পড়ুন: