
২০২২ সালের এপ্রিল মাস। রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা মুহূর্তেই দেশব্যাপী আলোচনার সমালোচনার জন্ম দেয় । তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার অভিযোগ করেন, কপালে টিপ পরার কারণে তিনি একজন পুলিশ সদস্য কর্তৃক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। অভিযুক্ত হন পুলিশের প্রটেকশন বিভাগের কনস্টেবল নাজমুল হাসান তারেক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হয়ে পড়ে। প্রতিবাদে সোচ্চার হন বহু সাংস্কৃতিক ও শোবিজ অঙ্গনের মানুষ। কিন্তু সময়ের আবর্তে প্রশ্ন উঠছে ঘটনাটি কি শুধুই নারী অধিকার রক্ষার ইস্যু, না কি এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে আরেকটি গভীর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র?
বিস্তারিত: https://www.youtube.com/watch?v=zhB_6TbB8kY&t=121s
২০২২ সালের ২ এপ্রিল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে রিকশায় করে কর্মস্থল তেজগাঁও কলেজের উদ্দেশে রওনা হন প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার। ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে নেমে হেঁটে যাচ্ছিলেন সেজান পয়েন্টের সামনে দিয়ে। সেখানেই মোটরসাইকেলে বসা পুলিশ পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি কটুক্তি করেন বলে অভিযোগ করেন লতা। তিনি বলেন, টিপ পরা নিয়ে কনস্টেবল অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং পরবর্তীতে মোটরসাইকেল চালিয়ে তার গায়ের ওপর তুলে দিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেন। শুধুমাত্র কপালে টিপ দেয়ার কারণে ওই নারীকে হত্যা করতে চান পুলিশ কনস্টেবল, এমন বানোয়াট অভিযোগের পর সারা দেশজুড়ে তোলপার শুরু করে কিছু শাহবাগী ও হাসিনার মদদপুষ্ট কিছু নারীবাদী শিল্পিরা । এ অভিযোগের ভিত্তিতে ওই সময় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে লতা সমাদ্দার ।
অভিযোগ পাওয়ার পর মাত্র দুই দিনের মধ্যে পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল হাসান তারেককে আটক করা হয়। তেজগাঁও বিভাগের তৎকালীন উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কনস্টেবল নাজমুলকে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত এবং পরে চাকরিচ্যুত করা হয়। ঘটনার তীব্রতা ও সামাজিক চাপের মুখে ডিএমপি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে অভিযুক্ত কনস্টেবল নাজমুল তারেক শুরু থেকেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আসছেন। বরখাস্ত হওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ঘটনাটি ছিল একটি দুর্ঘটনা। তিনি উল্টো পথে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় লতার গায়ে বাইক লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে চলে যেতে চাইলে, তার ইউনিফর্মের শোল্ডার ধরে ফেলা হয় বলে দাবি করেন তিনি। এরপর ঘটনাটি রঙচঙে করে উপস্থাপন করা হয়, যেন এটি নারী নির্যাতন বা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা জনিত অপরাধ।
তিনি অভিযোগ করেন, ঘটনাস্থলে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ না করেই তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন ছিল মনগড়া। বরং তার ইসলামিক চেহারা,দাড়ি-টুপি, নিয়মিত নামাজ আদায় করা এবং তার নিম্নপদস্থ পেশাগত অবস্থান সবই তাকে ষড়যন্ত্রের সহজ শিকার করেছে। সেসময় তাকে জামাত-শিবির ও জঙ্গি ট্যাগ দেন লতা সমাদ্দার।
ওই সময় সংবাদ সম্মেলন করেন নাজমুলের স্ত্রী মাইশা আক্তার। সত্য যদি প্রকাশ না পায়, তাহলে তাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে ন্যায়বিচার থাকবে না। কোনো প্রমাণ ছাড়া একটি পরিবারকে ধ্বংস করা অমানবিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি ।
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিপ পরে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে হাসিনার মদদপুষ্ট কিছি নারীবাদী শিল্পী ও শাহবাগীরা ।
বিষয়টি গড়ায় সংসদ পর্যন্ত । তৎকালীন অভিনেত্রী সাংসদ সুবর্ণা মুস্তফা সংসদে ওই শিক্ষিকার পক্ষে যুক্তি দিয়ে সংসদে কড়া সমালোচনা করেন ।
এই প্রতিবাদে শামিল হন গণহত্যার দায়ে আটক হওয়া তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী দীপু মনি তিনি ২০২২ সালের ৩ এপ্রিল নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ এ নিজের অনেকগুলো টিপ পরিহিত ছবি জুড়ে দিয়ে ক্যাপশন এ লিখেন, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, আমি নারী। এছাড়া, অভিনয়শিল্পী রাফিয়াথ রশিদ মিথিয়া,সাজু খাদেমসহ আরও অনেকে এ ঘটনায় ফুসলে ওঠেন। ওই টিপকান্ড গড়ায়, দাড়ি,টুপি ও ইসলামের বিরুদ্ধে এক প্রকার প্রতিবাদ।
শুধু তারেকই নয়। হাসিনার দাড়ি টুপির ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছেন এমন আরও এক অনেক পুলিশ সদস্য। কনস্টেবল তারেক আটকের পর অনেক পুরুষ শিল্পীরা অতি উৎসাহী হয়ে কপালে টিপ পরে প্রতিবাদ জানালে এর প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন সিলেট কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক মোঃ লিয়াকত আলী। এই ঘটনায় ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল লিয়াকত আলীকে ক্লোজড করা হয়।
টিপকাণ্ড নিয়ে একজন পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করায় ওই সময় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
২০২৫ সালের শুরুতে ঘটনাটি নতুন মোড় নেয়। নাজমুল তারেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মানহানির মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ছবি ও বক্তব্য ছড়ানো হয়। এতে তার পেশাগত, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে চরম ক্ষতি হয়েছে।
এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ১৮ জনকে, যার মধ্যে রয়েছেন ড. লতা সমাদ্দার, তার স্বামী অধ্যাপক মলয় মালা এবং শোবিজ অঙ্গনের ১৬ জন তারকা। তাদের মধ্যে আছেন সুবর্ণা মোস্তফা, আনিসুর রহমান মিলন, সায়মন সাদিক, মনোজ প্রামাণিক, চয়নিকা চৌধুরী, জ্যোতিকা জ্যোতি, উর্মিলা শ্রাবন্তী করসহ অনেকে।
নাজমুল তারেক ইতোমধ্যে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে চাকরিচ্যুতির আদেশ চ্যালেঞ্জ করেছেন। পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তরে চাকরিতে পুনর্বহালের আবেদন করেছেন। হাসিনার শাসনামলে শুধু এই পুলিশ কর্মকর্তাই নয়, প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকেই দাড়ি,টুপির জন্য হেয় করা হতো। সাধারণ মানুষ বলছে, কনস্টেবল নাজমুল হাসান তারেক হাসিনার হিন্দুত্ববাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। তাই তার চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সাধরণ মানুষ।
আরও পড়ুন: