
রাজধানী ঢাকায় বাড়িভাড়ার লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রা। বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতা, সরকারের নজরদারির অভাব ও ন্যায্য নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অভাবে বছরের পর বছর ধরে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অথচ, বাড়িভাড়ার বিপরীতে বসবাসের সুবিধা বা মানের কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি।
ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানায়, গত ২৫ বছরে ঢাকায় বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ, অর্থাৎ বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার পণ্যের দামের দ্বিগুণ। শুধু তাই নয়, গত ১৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৬২৮ শতাংশ, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য এক ভয়াবহ বাস্তবতা।
বাসা ছোট, ভাড়া বড়, সেবার বালাই নেই
বনশ্রীর ডি ব্লকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মো. আজহার শাহিন। স্ত্রী, এক কন্যা ও দুই ছোট ভাইকে নিয়ে তিনি থাকেন একটি দুই কক্ষের ছোট ফ্ল্যাটে। এই ছোট্ট বাসায় ডাইনিং স্পেস বলতে গেলে নেই বললেই চলে, তবে কোনোভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা থেকেই যায়—আলো-বাতাসের স্বাভাবিক চলাচলের সুযোগ নেই, একচিলতে বারান্দায় গিয়ে বাচ্চাটি একটু স্বস্তি পেলেও মশার উৎপাতের কারণে জানালা-দরজা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন তারা।
তাদের মাসিক ভাড়া ১৭ হাজার টাকা, যা দিতে হয় নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যেই। বেতন যদি দেরিতে পান, তবুও সময়মতো ভাড়া দিতে না পারলে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে শুনতে হয় নানা কথা। আজহারের মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বেতনের দুই-তৃতীয়াংশই চলে যাচ্ছে ভাড়ায়। তিনি বলেন, “বেতন পাওয়ার আগেই ভাড়ার চিন্তা করতে হয়। বাচ্চার জন্য কিছু কিনতে পারি না, সংসার খরচে প্রতিদিনই যুদ্ধ করতে হয়।”
ঢাকার সব এলাকায় একই চিত্র
এই সংকট শুধু আজহার শাহিনের নয়। রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই একই বাস্তবতা। পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা নাজমুল হোসেন বলেন, “মাত্র তিন বছরে ভাড়া ১২ হাজার থেকে ১৮ হাজার হয়েছে, কিন্তু বাসার কোনো উন্নয়ন হয়নি। পানির সমস্যা, ভাঙা বারান্দা—সবই আগের মতোই আছে।”
ভাটারায় গার্মেন্টসকর্মী সালমা বেগম থাকেন গ্যারেজে রূপান্তরিত এক ছোট রুমে। টিনের ছাউনির কারণে প্রচণ্ড গরমে থাকা যায় না, তবু বাধ্য হয়ে থাকেন। কারণ, অন্য কোথাও গেলে ভাড়া বহন করা সম্ভব নয়।
উত্তরায় নির্মাণাধীন ভবনের পাশে কনটেইনার ঘরে বসবাস করছে একাধিক পরিবার। এক মা বলেন, “৮-১০ হাজার টাকায় কোনো বাসা মেলে না। আর যেটা মেলে, সেখানে গ্যাস-পানি কিছুই ঠিকমতো পাওয়া যায় না।”
পরিসংখ্যানের চিত্র আরও ভয়াবহ
ক্যাব-এর এক জরিপ অনুযায়ী,
- ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের ৩০ শতাংশ ব্যয় করেন বাড়িভাড়ায়
- ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া ৫০ শতাংশ ব্যয় করেন
- এবং ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া তাদের আয়ের ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করেন কেবল ভাড়া পরিশোধে
এই চিত্র স্পষ্টভাবে দেখায়, রাজধানীর নাগরিকেরা শুধু ছাদটুকু টিকিয়ে রাখতেই মাসিক আয়ের বড় অংশ খরচ করছেন।
সরকারি নজরদারির অভাবেই পরিস্থিতির অবনতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকা না থাকায় বাড়িওয়ালারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। ঢাকা মহানগর এলাকায় বাড়িভাড়ার হার নির্ধারণে ১৯৯১ সালে একটি আইন করা হলেও তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। আজও এমন কোনো সক্রিয় তদারকি সংস্থা নেই, যারা নিয়মিত বাড়িভাড়ার মান ও পরিসেবা মূল্যায়ন করে পদক্ষেপ নেয়।
সমাধানে কী দরকার?
নগর বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর মতে,
-ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালার সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণে একটি কার্যকর ‘রেন্টাল অথরিটি’ গঠন
- বাসা ভাড়া নির্ধারণে মান, সেবা ও অবস্থানভিত্তিক মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি
- বাড়িভাড়া বৃদ্ধির সীমা নির্ধারণে আইন প্রয়োগ
- নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য সাশ্রয়ী আবাসনের সরকারি প্রকল্প বাড়ানো
এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন না হলে ঢাকায় বসবাস ক্রমেই অমানবিক হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: