শনিবার

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
১৩ আশ্বিন, ১৪৩১
২৪ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রতি খোলা চিঠি

শাহাদাৎ স্বাধীন

প্রকাশিত: ২৯ আগস্ট, ২০২৪ ০১:৩১

আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৭:২৫

শেয়ার

বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রতি খোলা চিঠি
বিপ্লবী ছাত্র জনতার দখলে গণভবন। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-নাগরিক আপনাদের অভিনন্দন। আপনাদের বিজয়ের শুভেচ্ছা। আপনারা শুধু নতুন বাংলাদেশের জন্ম দেননি, আপনারা সূচনা করেছেন দিনের। আমাদের চোখে যে নতুন স্বপ্নের ভোর ছিল তা আপনারা বাস্তবে এনেছেন।

আজ সারা পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। দক্ষিণ এশিয়া থেকে লাতিন আমেরিকা, আসিয়ান থেকে আফ্রিকা—সবার কাছে আপনারা উদাহরণ তৈরি করেছেন কীভাবে ছাত্র-নাগরিক একজন স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পারে!

বাংলাদেশকে বলা হয় ‘ল্যান্ড অব প্রটেস্ট’। বাঙালির রক্ত কখনো অন্যের নিয়ন্ত্রণ সহ্য করতে পারে না। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে অনেক আন্দোলন দেখেছি। দেশের বেশিরভাগ ছাত্র আন্দোলন এতদিন বন্দি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের কয়েকটি প্রথম সারির সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু এবারের আন্দোলন ছিল অভূতপূর্ব। এটিকে বলা হবে সত্যিকারের গণঅভ্যুত্থান। ছাত্রলীগ যখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হামলা করে হল বন্ধ ঘোষণা করল, তখন আন্দোলনে রসদ জোগালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, অথবা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে লড়াই করেছে, তা অভূতপূর্ব।

আন্দোলনের প্রথম শহীদ ঢাকার কেউ নন, তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আবু সাঈদ যেন রফিক-জব্বার হয়ে এসেছিলেন আরেকবার। আমাদের আরেক শহীদ মুগ্ধ। কারবালায় এসেছিলেন পানি বিলাতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম আন্দোলন যেখানে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেমে এসেছেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এসেছেন।

সন্তান এসেছে বাবার হাত ধরে, প্রেমিকা এসেছেন প্রেমিকের হাত ধরে, এসেছেন শ্রমিক, কৃষক, হকার, গার্মেন্টসকর্মী, দিনমজুর রিকশাওয়ালা। এসেছেন শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সামরিক কর্মকর্তা। ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক-কেরানি সবার রক্ত ঝরেছে ঢাকার রাজপথে। ফলে আমাদের জুলাই কোনো একক গোষ্ঠীর নয়; এই বিপ্লব সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের।

প্রিয় বন্ধুরা, আজও যখন আমি চোখ বন্ধ করি, শুনি, মুগ্ধ বলছে, ‘পানি লাগবে পানি’। কানে বাজে ‘আমাকে যেতে দেন না আমার একটা ছোট বোন আছে’। লজ্জায় ঘৃণায় মুখ ভরে উঠে ছ্যাপে যখন মনে পড়ে, ‘মাইরা তো ফেলছি এবার কি করবা’/ ‘আন্দোলনকারীদের ড্রাগস করানো হয়েছিল’। ‘একজনকে মারতে কয়টা গুলি লাগে স্যার’—এই লাইনটি আমরা কীভাবে ভুলে যাব! আমাদের কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্ত, কত মায়ের অশ্রু মিশে আছে এই আন্দোলনে!

আহত বন্ধুকে টেনে নেওয়ার সময় পুলিশে কাছ থেকে গিয়ে গুলি করছে, এই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, ‘জীবন বাঁচাতে ভবনে ঝুলে থাকা একটি ছেলেকে কীভাবে ঠান্ডা মাথায় খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে।’

আন্দোলনে ৪০০-এর অধিক শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন ২৫ হাজার। প্রত্যেক শহীদের আত্মত্যাগ, প্রতিজনের আহতের আহাজারির কথা জানলে আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। আমরা সবাই আবু সাঈদ, মুগ্ধের কথা জানি। কত শতশত আবু সাঈদ জীবন দিয়েছে!

হ্যাঁ বন্ধুরা, আমাদের আহত ভাই যথাযথ চিকিৎসা পাননি। শাটডাউনের কারণে ব্লাড ডোনারও মিলেনি। আমাদের কীভাবে হত্যা করা হয়েছে—আমরা কী ভুলে যাব!

আমাদের এই জুলাই বিপ্লবের চেতনা ধারণ করতে বিপ্লবের গল্পগাথা আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। শহীদদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। শহীদদের আদর্শ ও চেতনাকে আমাদের ধারণ করতে হবে। শহীদদের জীবনী ও আহতদের গল্প লিখুন, আপনারাও বিপ্লব দিনের ঘটনা লিখুন। আমাদের শহীদদের চেতনাকে ভুলিয়ে দিতে নানা ষড়যন্ত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই বন্ধুরা লিখুন, যাতে কেউ ইতিহাসকে কোনোভাবে মুছে দিতে না পারে। মনে রাখবেন শুধু শহীদরা আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে না, নতুন আমরা বিভক্ত হয়ে যাব নিজ নিজ স্বার্থে।

আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, কেন শ্রমিক বন্ধু, রিকশাওয়ালা ভাইটি আন্দোলনে এসেছিলেন। ফলে আমাদের নজর দিতে সবার জন্য বৈষম্যহীন মানবিক বাংলাদেশের।

প্রিয় বন্ধুরা, এটি গণবিপ্লব। গতানুগতিক আন্দোলনের ফ্রেমওয়ার্কে এটাকে বন্দি করবেন না। মানুষ এখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছেন। দেশের অনেক জায়গা আন্দোলন হয়েছে, যেখানে কোনো সমন্বয়ক ছিল না। যে নারী গ্রাফিতি করেছেন, যে ভাই ডিজিটাল ব্যানার করেছেন, ফেসবুকে লিখেছেন, ভিডিও বানিয়ে মানুষের আবেগে দোলা দিয়েছেন সেও এই আন্দোলনের অংশীদার।

যে ভাই-বোনেরা বিদেশে জনমত তৈরি করেছেন, বিদেশি মিডিয়ায় ছাত্র হত্যার খবর প্রকাশ করেছেন সেও আন্দোলনের অংশীদার। এই আন্দোলনে অন্তত ২৬টি র‌্যাপ সং আন্দোলনে গতি দিয়েছে। শত শত কবিতা ফেসবুকজুড়ে, উনারা সবাই আমাদের লোক। দুপুরবেলা যে মা বিস্কুট নিয়ে, যে বোন পানি নিয়ে এসেছেন সেও এই আন্দোলনের সমন্বয়ক। এই আন্দোলনে অনেক মানুষ এমন এমন ঝুঁকি নিয়েছেন, তা হয়তো আমাদের কাছে অজানাই থাকবে।

যখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হয় তখন ইস্ট ওয়েস্ট থেকে একঝাঁক ছাত্র এগিয়ে আসেন। তারা জানতেন তারা এলে তাদের গায়ে গুলি লাগবে, তবুও তারা এসেছেন। অস্ত্রের মুখ থেকে ভাইকে বাঁচাতে বুক পেতে দেওয়া প্রত্যেক সহযোদ্ধা আমাদের ভাই, আমাদের সমন্বয়ক।

আমাদের কলাম যোদ্ধা সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট, শিল্পী, সাহিত্যিক, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার যারা পাশে ছিলেন সবাই আমাদের সমন্বয়ক। বিজয়ের অংশীদার করুন সবাইকে। শেখ হাসিনা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে শুধু তার পরিবার ও তার দলের অবদান বলে কুক্ষিত করেছেন, এই বিপ্লব নিয়ে আমাদের আলোচনা যেন সেদিকে ধাবিত না হয়।

মনে রাখবেন আমরা যার যা আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কারণ আমরা সবাই মিলে দেশটা বাঁচাতে চেয়েছিলাম।

প্রিয় ছাত্র-নাগরিক,

আপনারা রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইলে দেশের মানুষ সাদরে গ্রহণ করবেন। দেশে একটি মধ্যপন্থি, উদার, গণতান্ত্রিক, তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক দলের উপযোগিতা রয়েছে। কিন্তু দয়া করে অন্যান্য গতানুগতিক দলের মতো রাজনীতিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক করে ফেলবেন না।

মেধা এখন নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নয়। যোগ্যতাও এখন কোনো শহরকেন্দ্রিক নয়। এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করুন, যেখানে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে যেন কেউ যোগ্যতা নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে যেতে পারেন। শ্রমিক ভাইটিও আসতে পারেন, কৃষক ভাইটিও যেন আসতেন। হিন্দু ভাই, চাকমা নারী সবার জন্য যেন দরজা উন্মুক্ত থাকে।

দেশে বিভক্তির রাজনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে আপনারা সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করুন। হেফাজতের আমির থেকে তসলিমা নাসরিন, পাহাড়ের চাকমা নারী থেকে আহমেদিয়া সম্প্রদায় সবাই কথা বলার সুযোগ পায়। কথা বলার জন্য যেন কারও জীবন হুমকির মুখে না পড়ে।

অসীম সম্ভাবনার এই দেশ। স্বাধীনতা ৫০ বছরে আমাদের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য বুর্জোয়া পুঁজিবাদী রাজনীতি, ও লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি। চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, ঘুষ, দুর্নীতি, মাফিয়া সিন্ডিকেট দেশটাকে আগাতে দিচ্ছে না। যে আলু বগুড়ায় ১০ টাকা কেজি তা ঢাকায় ৬০ টাকা। যেন দেখার কেউ নেই। ঢাকার মতো একটি শহরে নেই চলাচলের উপযোগী পাবলিক ট্রান্সপোর্ট।

লেখক: গবেষক, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি

সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়