১৯৭৫ সালের সাত নভেম্বরের ‘সিপাহী-জনতার বিল্পব’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পথে এই বিপ্লব একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই দিনটি কারো কাছে ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’, কারো কাছে ‘সৈনিক জনতার অভ্যুত্থান দিবস’, আবার কারো কাছে বা ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত।
১৯১৭ সালের সাত নভেম্বর (তৎকালীন চালু বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ২৫শে অক্টোবর) ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে পরিচালিত দুনিয়া কাঁপানো রাশিয়ার ‘বলশেভিক বিল্পব’ (‘অক্টোবর বিল্পব’ নামে অভিহিত) এর মতো ‘সিপাহী-জনতার বিল্পব’ ও বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার গতি ও রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনে একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। বাংলাদেশে প্রেক্ষিতে সাত নভেম্বর মূলত সংঘাতময় রাষ্ট্রিক চরিত্র থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি গণঅংশগ্রহণমূলক ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থার পথ চলা শুরু হয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র ও গণমানুষের মন বুঝতে (রিড করা) সক্ষম হওয়ায়, রাজনীতিক না হয়েও জেনারেল জিয়াউর রহমান সাত নভেম্বর পূর্ববর্তী মুজিব শাসনামলের সংঘাতময় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে ইতিহাসে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। সাত নভেম্বর পূর্বাপর ঘটনাবলীর প্রভাব ও ফলাফল নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এই নিবন্ধে অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ও বর্তমান বিশ্বচিন্তায় (রাজনৈতিক অর্থনীতি) অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে ডগলাস নর্থ এবং তাঁর সহ-চিন্তকদের ‘ভায়োলেন্স অ্যান্ড সোশ্যাল অর্ডারস’ নামে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সাত নভেম্বরের পূর্বাপর ঘটনাবলীর প্রাসঙ্গিকতা খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিল্পবের তাত্ত্বিক ভিত্তি- ডগলাস নর্থ ও অন্যান্য
সাত নভেম্বরের বিল্পব অনেকটা ডগলাস নর্থ, জোসেফ ওয়ালিস এবং ব্যারি উইনগাস্টের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রায়োগিক প্রতিফলন বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশ্বখ্যাত এই তিনচিন্তক তাঁদের এই শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী বই ‘ভায়োলেন্স অ্যান্ড সোশ্যাল অর্ডারস: অ্যা কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক ফর ইন্টারপ্রেটিং রেকর্ডেড হিউম্যান হিস্ট্রি, ২০০৯’- এ বিশ্বব্যাপি সহিংসতা এবং মানুষের সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠনে সহিংসতার ভূমিকার ওপর গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। নর্থ এবং তাঁর সহকর্মীরা যুক্তি দেন যে, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা স্থিতিশীল সমাজ (রাষ্ট্র) গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মানবসমাজে সহিংসতা কিংবা সহিংসতার সম্ভাবনা একটি স্থায়ী চ্যালেঞ্জ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা হয়? সেটা সমাজের বিদ্যমান কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- বিশ্বব্যাপি সমাজগুলো সীমিত প্রবেশাধিকার ব্যবস্থা (লিমিটেড অ্যাকসেস ওর্ডার) থেকে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার ব্যবস্থায় (ওপেন অ্যাকসেস ওর্ডার) রূপান্তরিত হয়, তা বোঝা প্রয়োজন। এই রূপান্তর অনেক কঠিন এবং এর জন্য সম্পত্তির অধিকার, স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করা প্রয়োজন।
নর্থ এবং তার সহকর্মীরা যুক্তি দেন যে- কিছু সমাজ সহিংসতা এবং পশ্চাৎপদতার চক্রে আটকে থাকে, অন্যদিকে কিছু সমাজ স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়। এছাড়া তাঁরা যুক্তি দেন যে- উন্নয়ন কৌশলগুলো এমন প্রতিষ্ঠান তৈরিতে মনোযোগী হওয়া উচিত, যা সহিংসতা সীমিত করে এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক প্রবেশাধিকার প্রচার করে।
ডগলাস নর্থ ও অন্যান্যের ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে ৭ নভেম্বর পূর্বাপর বাংলাদেশ
অর্থনীতিবিদ ডগলাস এবং তার সহকর্মীদের তাত্ত্বিক ধারণা ও ব্যাখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে- বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মোটাদাগে বলা যায়, সাত নভেম্বর এর বিপ্লবের পর জিয়াউর রহমানের বিচক্ষণতা এবং সামরিক ব্যক্তি হয়েও বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র ও জনমানুষের মন বুঝার (‘রিড করা’) সক্ষমতা মূলত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এর প্রাতিষ্ঠানিক তথা প্রায়োগিক রূপ লাভের সুযোগ ও ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ’- মূলত বাংলা ভাষাভাষি তথা বাঙ্গালি জাতির শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি, কিন্তু এর দ্বারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির বহুজাতিভিত্তিক চারিত্রিক কাঠামোর অস্তিত্বকে কার্যত অস্বীকার করার নামান্তর। বাংলাদেশে থাকা অন্যসব জাতি, যেমন- চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ইত্যাদিকে কার্যত উপেক্ষা ও অসম্মান করা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে জাতিভিত্তিক বৈষম্য ও বিদ্বেষ তথা রাষ্ট্রকাঠামোতে জাতিভিত্তিক সাংঘর্ষিক পরিবেশ সৃষ্টির উপাদান বা বীজপ্রথিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামোর চরিত্রকে অস্বীকৃতির দ্বারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমাজ-কাঠামোতে বিভক্তি ও সংঘর্ষ সৃষ্টির বীজবপন করে দিয়েছেন- যার অনিবার্য পরিণতি হলো দেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আলাদা হওয়ার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা।
আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের ভিন্ন-ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষকে এক ছাদের নীচে আনার কথিত প্রচেষ্টা- কার্যত ভিন্নমত চর্চার সংস্কৃতিকে পুরোপুরি মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিলো। বাকশাল দ্বারা মূলত বহুদলীয় রাজনৈতিক মত ও পথ রুদ্ধকরার মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করা হয়। এছাড়া নিয়মিত সামরিকবাহিনীর পরিবর্তে রক্ষীবাহিনী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এবং সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধাদের (পাকিস্তান ও ভারত ফেরৎ) মধ্যে বিরোধের কার্যকর মীমাংসায় ব্যর্থতা; বহুমত ও সমালোচনাকে সহ্য করতে না পেরে তথা গণকণ্ঠকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাত্র চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা; জাসদের সশস্ত্র কর্মীদের সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারা, ইত্যাদি কারণে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সেনাবাহিনীর একাংশের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর মূলত ভারত-রাশিয়া (তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন) পন্থী ও রুশ-ভারতবিরোধী এই দু’টি ধারায় স্পষ্ট হয়। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর মাধ্যমে জেনারেল খালেদ মোশাররফ কর্তৃক অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার প্রচেষ্টা থেকে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।
১৯৭৫ সালের ছয় নভেম্বর রুশ-ভারতপন্থী জেনারেল খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান করে নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করার পাশাপাশি জেনারেল জিয়াকে ঢাকা সেনানিবাসে স্বপরিবারে বন্দী করেন। তবে, জিয়ার প্রতি সাধারণ সৈনিকদের অসম্ভব আস্থা থাকার জন্যই পরের দিন অর্থাৎ সাত নভেম্বর সাধারণ সৈনিক বা সিপাহীদের পাশাপাশি সেনানিবাসের আশপাশে থাকা সাধারণ মানুষ জেনারেল জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
অপরদিকে, সাত নভেম্বর পরবর্তী জিয়াউর রহমান এর ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ এর ধারণা বাংলাদেশের বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রচরিত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
জিয়ার জাতীয়তাবাদী ধারণা অপেক্ষাকৃত উদার, বহুপক্ষীয় এবং সমাজে জাতি, বর্ণ ও ধর্মীয় পরিচয়গত বিভাজন অনুমোদন করে না। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়ার সার্বিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বহুবর্ণীয় ও জাতিগত দিক থেকে বহুপক্ষীয় এবং অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জিয়াউর রহমানের একক চিন্তার ফসল না। মাওলানা ভাসানী ও আবুল মনসুর আহমদের বক্তৃতা ও লেখায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের উল্লেখ পাওয়া গেলেও এর বাস্তব রূপদান করেন জিয়া।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সে সময়কার মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠসহ মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসী ভূমিকার কারণে জিয়া সাধারণ সৈনিক ও জনগণের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় ও বিশ্বাসভাজন হন। জিয়ার প্রতি সাধারণ সৈনিকদের বিশ্বাস ও জনপ্রিয়তার কাছে কার্যত ধরাশায়ী হন ভারতপন্থী জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং জাসদ নেতা কর্নেল তাহেরের সেনা অভ্যুত্থান।
১৫ই আগাস্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনীতে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের কারণে যে বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সংকট তৈরি হয়েছিল (ডগলাস নর্থ ও সহচিন্তকদের মতে তা ‘ভায়োলেন্স’) তার অনিবার্য পরিসমাপ্তি ঘটে সাত নভেম্বর সিপাহি-জনতার মাধ্যমে তখনকার জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা বসানোর মাধ্যমে। সিপাহী-জনতার সহায়তায় জিয়ার ক্ষমতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দ্রুত সেনাবাহিনীসহ সর্বক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
অনেকে সাত নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহকে মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধের তিন সাহসী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান ও আবু তাহেরের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে বিবেচনা করলেও, দিনশেষে জিয়া সেই সংঘাতময় পরিস্থিতি উৎরে নায়কবনে যেতে সক্ষম হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারের মাধ্যমে জিয়ার কণ্ঠে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার কারণে জিয়ার জনপ্রিয়তা আগে থেকেই সামরিকবাহিনী এবং জনমনে আস্থা ও নির্ভরতা তৈরি করে রেখেছিলো। এর পাশাপাশি জিয়ার বিচক্ষণতা ও ভাগ্য সহায়ক হওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর উদ্ভূত অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় রাজনৈতিক সংকটকালে সিপাহি জনতার সম্মিলিত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়া ক্ষমতার মঞ্চে উপবিষ্ট হতে সক্ষম হন।
সাত নভেম্বরের পর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। জিয়ার শাসনামলে সংঘটিত কমপক্ষে ২০টি সামরিক অভ্যুত্থান শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হন। জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর মধ্যে দু’টি প্রধান ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথমটি শেখ মুজিব নিজেই সৃষ্টি করেন। ভারতের অভিপ্রায়ে শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর সমান্তরালে রক্ষীবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। রক্ষীবাহিনী প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলো- সেনাবাহিনীর প্রতি শেখ মুজিবের অবিশ্বাস; আর দ্বিতীয়টি ছিলো- সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা ও অমুক্তিযোদ্ধা সেনাদের (যুদ্ধের সময় যারা পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতে অবস্থান করেছিলো) মধ্যকার বিরোধ।
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অফ দ্য হিস্টোরিয়ানে প্রকাশিত নথিতে ১৯৭১ সালের ছয় ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে এক মিটিংয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল আর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে চলমান আলোচনায় শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মার্কিন কূটনীতিক জনসন বলেছিলেন- ‘তারা হবে আন্তর্জাতিক এক ঝুড়ি’। প্রতিউত্তরে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন- ‘তবে জরুরি না যে সেই ঝুড়ি আমাদের হবে।’ তবে, এই মন্তব্যকে অনেকে তৎকালীন মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের চালিয়ে থাকেন। মার্কিন কূটনীতিকের মন্তব্য শেখ মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অক্ষরে-অক্ষরে প্রতিফলিত হয়।
মুজিবের শাসনামলে প্রশাসনিক ও নেতৃত্বের ব্যর্থতায় দেশের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। দেশের সরকারি গোডাউন ও বেসরকারি আড়তে যথেষ্ট খাদ্যদ্রব্য মজুত থাকলেও অসৎ মজুতদারি ও কালোবাজারির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে তা সহজলভ্য ছিলো না। এই কৃত্তিম খাদ্য সংকটের কারণে ১৯৭২ সাল থেকে দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৭৪ সালে তা চরম আকারে ধারণ করে। অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে মৃত্যুর জন্য শেখ মুজিবের প্রশাসনিক ব্যর্থতা মূল কারণ। নোবেল পুরস্কারবিজয়ী ভারতীয় বাঙ্গালি অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেনের বিশ্বখ্যাত বই ‘পভারটি অ্যান্ড ফেমিনস: অ্যান এসে অন এনটাইটেলটেমেন্ট অ্যান্ড ডিপ্রাইভেশন, ১৯৮১’ এ বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত আছে।
দুর্ভিক্ষকবলিত ও ‘তলাবিহিন ঝুঁড়ির’ দেশকে জিয়াউর রহমান খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত করতে অনন্য ভূমিকা রাখেন। সারাদেশে খাল কাটা কর্মসূচির দ্বারা একদিকে মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, অপরদিকে খাদ্য উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় দেশ দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায়। জিয়া দেশে কৃষিবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করে সবুজ বিল্পবের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেন।
এভাবে, সাত নভেম্বর পূর্ব এক বিশৃঙ্খল ও সহিংস পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বহুদলীয় রাজনৈতিক চর্চার প্রবর্তন, রাষ্ট্রের বহুজাতির অস্তিত্বের সমান স্বীকৃতি তথা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি পুনর্গঠনসহ দেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করাসহ নানা প্রকার জনপ্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনমনে আস্থা অর্জন করেন। জিয়ার দূরদর্শী নেতৃত্বে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও দাদাগিরি, অর্থনৈতিক সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য এবং রাজনৈতিক সংঘাতসহ সামরিক-বেসামরিক (সিভিল-মিলিটারি) মুখোমুখি তথা সংঘাতময় ও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়া আরো কিছুদিন দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে হয়তো মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশে সর্বদলীয় রাজনৈতিক বন্দোবস্ত (‘পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট’) প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হতো।
সার্বিকভাবে, ১৯৭৫ সালের সাত নভেম্বর জিয়াউর রহমানের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা (ডগলাস নর্থদের মতে সোশ্যাল অর্ডার) এবং বহুদলীয় ও বহু মতাদর্শ ভিত্তিক স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিগন্ত উন্মোচিত ও ত্বরান্বিত হয়।
লেখক- মো. রেযাউল করিম
গবেষক- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (২০০৬-’২১)
পিএইচডি কেনডিডেট- মালায়া বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
মাস্টার্স- অ্যান্টিকরাপশন স্টাডিজ, অস্ট্রিয়া
লাইসেন্সড প্রডিউসার- প্রপার্টি অ্যান্ড ক্যাজুয়ালটি ইন্সুরেন্স, নিউ ইয়র্ক
ই-মেইল: [email protected]
আরও পড়ুন: