বৃহস্পতিবার

৩০ জানুয়ারি, ২০২৫
১৭ মাঘ, ১৪৩১
৩০ রজব, ১৪৪৬

আধিপত্যবাদ এবং নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা

ড. মোঃ ফরিদ তালুকদার

প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১৬:৩১

শেয়ার

আধিপত্যবাদ এবং নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা
লেখক: ড. মোঃ ফরিদ তালুকদার।

আধিপত্যবাদ:
ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করে যুবকদের যে অবস্থান সেখান থেকে আর পিছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রকে শক্তিশালী হতে হয়। আর এই শক্তিশালী হতে গেলে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতেই হবে। তাই যেই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যাচ্ছে, সেটা যাওয়ারই কথা। এই চ্যালেঞ্জ সামনে আরো বাড়বে এবং চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে বাংলাদেশ শক্তিশালী হবে।

পৃথিবীর সকল শক্তিশালী রাষ্ট্রই নানাবিধ চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আজ শক্তিশালী হয়েছে, উন্নত হয়েছে, টেকসই হয়েছে। আমাদের হয়তো সময় লাগবে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে! তবে শক্তিশালী হতে হলে, টেকসই হতে হলে, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। স্বাধীন এবং শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সব সময়ই চায় প্রতিবেশীসহ অন্য সকল রাষ্ট্রের সাথে সমতাভিত্তিক, ন্যায্যতাভিত্তিক, সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখতে।

জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভাজনহীন একটি ভাষার দেশ বাংলাদেশ। এমন রাষ্ট্র খুব কমই আছে পৃথিবীতে। ভাষাগত, ধর্মীয়, এবং জাতিগত সাংঘর্ষিক বিভাজন না থাকার কারণে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সহ অন্যান্য ভিনদেশী আগ্রাসন মোকাবেলা করার মত সক্ষমতা বাংলাদেশের জনগণের আছে।

প্রেক্ষাপট:
বাকশাল থেকে ১৯৯০, বাংলাদেশের অস্থিরতার মূলে ছিল রাজনৈতিক সঙ্কট তথা সীমিত গণতন্ত্র এবং কখনও কখনও গণতন্ত্রহীনতা। তাই ৯০’র বিপ্লবও ছিল স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা।  ২০০৯ সালের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নির্বাচিত আওয়ামী সরকার ১৫ বছরে নিজেকে ফ্যাসিস্ট  শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে ভারতের হাতে তুলে দেয়।

ফলশ্রুতিতে ৩৪ বছর পরে  ২০২৪ সালে এদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে আবারও একটি গণবিপ্লব সংগঠিত করে ক্ষমতাচ্যুত করে ইতিহাসের বর্বরতম ফ্যাসিস্ট শাসককে। ১৯৯০ সালে পতন হওয়া স্বৈরশাসন এবং ২০২৪ সালে পতন হওয়া ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্যে রাজনীতি কেন্দ্রিক, সমাজ কেন্দ্রিক, আইনের শাসন কেন্দ্রিক, এবং মানুষের অধিকার কেন্দ্রিক আচরণে এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য অনেক।   
ফ্যাসিবাদী শাসনে আমরা দেখিছি গুম (মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের বরাত দিয়ে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (অগাস্ট ৩০, ২০২৪) বলছে ৭০৮ জন গুম হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে), বিচার বহির্ভূত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড (প্রথম আলো ৩ নভেম্বর’২৪ প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে কমপক্ষে ১৯২৬ জনকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়), আয়নাঘরে নির্যাতন ( নিউ ইয়র্ক টাইমস অক্টোবর ১৭, ২০২৪ এর প্রতিবেদনে আয়না ঘরের ভিকটিমদের কিছু নির্যাতনের  ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে এমনও ভিকটিম আছে যে গত ৫ বছর আয়নাঘরে থাকা অবস্থায় একবারের জন্যও সূর্যের আলো দেখেননি ), ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের নামে দেশপ্রেমিক সেনা হত্যা, ২০১৩ সালে ৫ই মে, হেফাজতের সমাবেশে মাদ্রাসার ছাত্রসহ হুজুরদের হত্যা (২৩০ জনের বেশি হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে ১৮ অগাস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়)। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাচ্যুতির ঠিক আগ মুহূর্তে, এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে হত্যা করা হয় এক হাজারেরও অধিক মানুষ (রয়টার্স ২৯ অগাস্ট ২০২৪) (যাদের বেশির ভাগ ছাত্র, আছে শিশু এবং নারীও), শত শত মানুষকে করে পঙ্গু, কেড়ে নেয় দৃষ্টিশক্তি।  

৯০'র স্বৈরশাসনের সময়ও বাংলাদেশ এত ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হয়নি। তাই  স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া  বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা,  ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা থেকে ভিন্ন হবে এবং হওয়া উচিৎও। কারণ চাকুরীতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলেও মূলত আন্দোলন ছিল বিরাজমান অপরাপর বৈষম্য এবং ভারতের আদিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। যেই আদিপত্যবাদের মাধ্যমে ভারত কেবল আওয়ামীলীগের সাথে সম্পর্ক রেখেছে, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় অযাচিত অন্যায় হস্তক্ষেপ করেছে এবং অসমানুপাতিক ভাবে বাংলাদেশ থেকে সুবিধা নিয়েছে। সুতরাং,  ২০২৪ সালে যেই গণবিপ্লব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তার আকাঙ্ক্ষা অপরাপর বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা হতে ভিন্ন এবং ব্যাপক। 

করণীয়: 
বৈষম্য, ধ্বংসপ্রাপ্ত গণতান্ত্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং জেঁকে বসা আদিপত্যবাদ কেবল একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে দূর করা বা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না, যদি না গণবিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা না যায়।  

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন অপরিহার্য। ফ্যাসিবাদী শাসন নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং  প্রতিষ্ঠানকে  ধ্বংস করে যেই অবস্থায় রেখে গেছে তা যদি জন আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংস্কার করা না যায় তাহলে গণতান্ত্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকবে অনেক দুর্বল, যার উপর ভর দিয়ে ভবিষ্যতে আরো শক্তিশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হবে ভারতীয় আধিপত্য। এদেশের ছাত্র-জনতা-সিপাহী ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রক্ত দিয়ে, দৃষ্টিশক্তি  হারিয়ে এবং জীবন দিয়ে একের পর এক বিপ্লব করেই যাবে এমনটিতো হবে না বা হওয়া উচিৎও না।    

জেনারেশন ওয়াই (Gen Y)  (জন্ম ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬) জেনারেশন জেড (Gen Z) (জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২), জেনারেশন আলফা (Gen Alpha) (জন্ম ২০১২ থেকে ২০২৪), প্রযুক্তিগতভাবে আগের যে কোন জেনারেশন যেমন জেনারেশন এক্স (Gen X) (জন্ম ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০) এবং বেবি বুমার (Baby boomers) (জন্ম ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪) থেকে অনেক অনেক এগিয়ে।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কারনে আমার বেশিরভাগ কাজই এই প্রজন্মের সাথে। তাই আমি জানি এই প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকা প্রজন্ম এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে যেখানে গড়ে উঠবে ড্রোন ইন্ডাস্ট্রি, রোবট ইন্ডাস্ট্রি, ক্লাউড ইন্ডাস্ট্রি, এবং আইটি হাব (Hub)। শুধু তাই নয়, তারা গবেষণা করে বিগ ডাটা নিয়ে।

যার কারণে গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের ব্যর্থতার এবং সমসাময়িক সময়ে স্বাধীনতা প্রাপ্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের সফলতার কারণ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্যগত ধারণা তাঁদের আছে। এমন কি তাঁরা বিশ্বাস করে বাংলাদেশে যে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হল, ভারতীয় আগ্রাসন শিকড় গাড়ল, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত ভাবে বাংলাদেশ যে পিছিয়ে রইল তার  জন্য আগের প্রজন্ম অনেকাংশে দায়ী।  

এজন্য এই প্রজন্মের  মধ্যে যৌক্তিক আশঙ্কা আছে যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছাড়া, প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া, জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন সংবিধান প্রণয়ন ছাড়া কেবল একটি নির্বাচনের মাধ্যমে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়, তাহলে তারা ঐ কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পাবে না যেমন বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য আবু সাঈদ, মুগ্ধ সহ অগণিত বীরেরা  জীবন দিয়েছে, অন্ধ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন হয়েছে, এমন কি পরিবার জানেও না  তাদের প্রিয়জনের কবরটা কোথায়।  

তাই দৃশ্যমান নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সংস্কার, এবং সংবিধান পুনর্লিখন বা ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়া কেবল একটি নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে জেনারেশন এক্স এবং বেবি বুমারদের সাথে পরবর্তী সকল জেনারেশনের দুরুত্ব বাড়বে, বিভাজন তৈরি হবে, রাষ্ট্র দুর্বল হবে, যা নতুন ফ্যাসিবাদ সহ ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হবে নিশ্চিত ভাবেই। 

লেখক: ড. মোঃ ফরিদ তালুকদার
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অফ ম্যানেজমেন্ট
ম্যাকনিস স্টেট ইউনিভার্সিটি, লুইসিয়ানা, ইউএসএ