বৃহস্পতিবার

৩০ জানুয়ারি, ২০২৫
১৭ মাঘ, ১৪৩১
৩০ রজব, ১৪৪৬

ভারতীয় আগ্রাসন ও আমাদের প্রস্তুতি

আশফাকুর রহমান

প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫ ১৩:৫৫

শেয়ার

ভারতীয় আগ্রাসন ও আমাদের প্রস্তুতি
ছবি: আশফাকুর রহমান।

ভারতের আগ্রাসন সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষকে আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। বছরের পর বছর সীমান্তে নির্বিচার মানুষ হত্যা, অন্যায্য ট্রানজিট সুবিধা কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে গুম কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী গুমকাজে সম্পৃক্ত থাকা; বলতে থাকলে লিস্ট শুধু লম্বাই হবে। তাই তরুণ প্রজন্মের মাঝে এই অভূতপূর্ব জাগরণকে কাজে লাগিয়ে ভারত থেকে কিভাবে আমরা ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারি সেটা নিয়ে আলাপ করাটা জরুরী।

চোখে চোখ রেখে কথা বলা

“আমরা তাদের সাথে ভালো আচরণ করলে তারাও আমাদের প্রতি সদয় হবে।” এই নীতি ভারতের সাথে যায় না। কেননা তারা চাণক্য নীতি অনুসরণ করে যেখানে প্রতিবেশীকে শত্রু বলে গণ্য করা হয় এবং দাবিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করা হয়। অতএব শত্রু যে ভাষা বোঝে তার সাথে সে ভাষায় কথা বললে শত্রু আপনার সাথে আলোচনার টেবিলে বসবে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির বাংলাদেশ সফর তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যখন ভারত দেখল আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দল মত নির্বিশেষে ফ্যাসিবাদী সমস্ত শক্তি ঐক্যবদ্ধ তখনই তারা তাদের লোক পাঠিয়ে দিল আলোচনার জন্য।

নিরাপত্তা চুক্তি ও বিপ্লবী বাহিনী গঠন

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কেউ কারও চিরকালীন বন্ধু বা শত্রু নয়। নিজেদের স্বার্থই এখানে শেষ কথা। আর “শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু”; রাজনীতিতে এটা অনেক প্রাচীন এক কৌশল। অতএব পাকিস্তানের সাথে অবশ্যই আমাদের সামরিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। পাকিস্তানের থেকে সরাসরি পণ্য আমদানি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তবে এ সম্পর্ক আরও বাড়ানো চাই। কোন সন্দেহ নেই ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক যেকোন সংগ্রামে আমরা পাকিস্তানকে পাশে পাব আর পাকিস্তান মিলিটারির সামরিক দক্ষতার প্রশংসা তো গোটা দুনিয়ায় শোনা যায়। পাকিস্তান একটি দরিদ্র রাষ্ট্র হতে পারে কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না পাকিস্তান একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যারা পারমানবিক শক্তি সম্পন্ন। তাই আমাদের অবশ্যই এটা থেকে উপকৃত হওয়া চাই।

দেরী হয়ে গেলেও আমি মনে করি বিপ্লবী ছাত্র-জনতা কে নিয়ে একটি নতুন বিপ্লবী বাহিনী গঠনের সুযোগ এখনও আছে। এক্ষেত্রে ইরান খুব ভালো একটা উদাহরণ। আমরা যদি নিজেদের মত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রনীতি গঠন করতে চাই তবে বিপ্লবী বাহিনী গঠনের কোন বিকল্প নেই। ১৮-৩৫ বছর বয়সী সকল সামর্থ্যবান পুরুষ এই বাহিনীতে শরিক হতে পারে। খুনি হাসিনার পুলিশ লীগের সংস্কার প্রক্রিয়া কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা নিষিদ্ধ র‍্যাব থেকে এই বিপ্লবী বাহিনী অনেক ভালো কাজ করবে। অনেক সময় সংস্কার করা থেকে নতুন করে শুরু করা অনেক সহজ। জুলাই বিপ্লব একটা বিষয় প্রমাণ করে দিয়েছে ১৮-৩৫ বছর বয়সী এই তরুণ প্রজন্ম এখনও পচে যায়নি এবং যেকোন অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে তারা ভয় পায় না।

বাণিজ্য নির্ভরতা কমানো

গত অর্থ বছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এই বিশাল বাণিজ্যের সুযোগ নিয়েই তারা প্রায়ই আমাদের চাপে রাখে এবং নিজেদের সুবিধামত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তাই ভারত থেকে এই আমদানি নির্ভরতা কমানোর কোন বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে গার্মেন্টসের অনেক কাঁচামাল আমরা পাকিস্তান থেকে আনছি। আর চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও গভীর করা দরকার। চীন অনেক বিশাল অর্থনীতির দেশ। চীন আমাদের যা দিতে পারবে ভারত কখনই তা দিতে পারবে না। এমন পলিসি হাতে নেয়া দরকার যাতে চীন থেকে আমরা আরও বেশী শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে পারি।

আর চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও গভীর করা দরকার। চীন অনেক বিশাল অর্থনীতির দেশ। চীন আমাদের যা দিতে পারবে ভারত কখনই তা দিতে পারবে না। এমন পলিসি হাতে নেয়া দরকার যাতে চীন থেকে আমরা আরও বেশী শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে পারি। ব্যাপক শিল্প উন্নয়নের জন্য চীন থেকে লোন না করে আমরা ধারে কাঁচামাল আমদানি করতে পারি এবং প্রয়োজনে তাদের সাথে পার্টনারশিপে যেতে পারি। চীনা কাঁচামাল এবং প্রযুক্তি দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের উচিত ভারি শিল্পে মনযোগী হওয়া। ব্যাপক চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি বা অপরাধপ্রবণতা কখনই কমবে না। আর কৃষি পণ্যের জন্য আমাদের অবশ্যই মায়ানমার, ইরান, আফগানিস্তান, তুরস্কের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এভাবে আমরা ভারতের থেকে যত বেশী নির্ভরতা কমাতে পারব তাদের দাদাগিরি ফলানোর সুযোগ তত কমে আসবে।

সুশীল সমাজের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা

সাংস্কৃতিকভাবে ভারত আমাদের সবচেয়ে কাছাকাছি। কিন্তু তাদের আগ্রাসী নীতির কারণে বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশী দেশের সাথে তাদের খারাপ সম্পর্ক। ভারতের জনগণকে এ বিষয়টি বোঝানো জরুরী। ইন্টারনেটের এই দুনিয়াতে এখন আমরা সবাই কানেক্টেড। তাই সোশ্যাল মিডিয়াতে এটি নিয়ে অনেক বেশী লেখালেখি করা দরকার। ভারতের জনগণের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই। এসব নিয়ে ভারতের জনগণের সাথে খোলাখুলি আলোচনা দরকার। আমরা যদি তাদের বোঝাতে সক্ষম হই তাহলে তারাই তাদের সরকারকে ন্যায্য সম্পর্কের জন্য জোর দিবে। অরুন্ধতী রায়ের মত বুদ্ধিজীবীদের সাথে আমাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং একটি যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

আমাদের অনেক রাজনীতিবিদ এবং ছাত্রনেতাকে সেভেন সিস্টারস নিয়ে আগ্রাসী বক্তব্য দিতে দেখা যায়। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির জন্য এটা সহায়ক হতে পারে কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে আমরা যদি বিশ্বের সমর্থন চাই, তার জন্য এটা খুব সহায়ক হবে কি? মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ থেকে বহিঃবিশ্বে ভারতের প্রভাব অনেক বেশী। এসব উসকানি মূলক বক্তব্য ভারতকে তার আগ্রাসন অব্যাহত রাখার কেবল বৈধতাই দিবে। তাই আমাদের অবশ্যই ভারতের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সম্মান করতে হবে পাশাপাশি নিজেদেরকে বিশ্বের দরবারে ভিকটিম হিসেবে পেশ করতে হবে। যাতে এ প্রতিরোধ লড়াইয়ে আমরা গোটা বিশ্বের অন্তত নৈতিক সমর্থন পাই। ভারতের অখণ্ডতাকে মেনে নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণের তাই কোন বিকল্প নেই।

অভিন্ন জাতীয় ইস্যু

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আমাদের কিছু অভিন্ন জাতীয় ইস্যু থাকা দরকার। ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন আমাদের জাতীয় ইস্যুর বিরুদ্ধে যাতে কেউ যেতে না পারে সেরকম একটি পরিবেশ তৈরি করা দরকার। ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবেলা হওয়া উচিত আমাদের সেই অভিন্ন জাতীয় ইস্যুর অন্যতম। তাই ভবিষ্যতে জনগণের ভোটে যারাই নির্বাচিত হোক না কেন ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবেলায় তারা কেমন পারফর্ম করে সেটার দিকে সবাইকে অবশ্যই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কেউ যদি পলাতক খুনি হাসিনার পথ অনুসরণ করে তবে সেও ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।

ভারত আমাদের বৃহত্তম প্রতিবেশী। তাই আমরা যদি তাদের সাথে ন্যায্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারি তবে এরচেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। এটাই হওয়া উচিত নতুন বাংলাদেশের মুল বয়ান। মুক্তির অন্যতম পথ।

লেখক: আশফাকুর রহমান, সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।