
ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ ছিল কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক সমাজ গঠন, শরিয়াহর প্রয়োগ, এবং মানবতার কল্যাণে নেতৃত্ব প্রদান। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এ দলের নীতি ও আচরণে এমন সব বৈপরীত্য ও দ্বিচারিতা দেখা গেছে, যা তাদের ইসলামপন্থী দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম যে স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেয়, সেই মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে জামায়াত বহুবার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আপোস, প্রতারণা ও ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করেছে।
জামায়াতে ইসলামী: সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
১৯৪১ সালে আবুল আ’লা মওদূদী পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা করেন। তার আদর্শ ছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করা, যেখানে কুরআনের আইনই হবে শাসনের মূল ভিত্তি। ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানেও জামায়াতের শাখা গড়ে ওঠে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত তারা এককভাবে পাকিস্তানপন্থী অবস্থান বজায় রাখে। তারা বাংলা ভাষা আন্দোলণে তাদের কিছু অবদান থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। স্বাধীনতার পরে এক পর্যায়ে দলটি রাজনৈতিক পুনর্বাসন পায় এবং আবারো ইসলামী রাজনীতির নামে নিজেদের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
ইসলামী শাসনের দাবি বনাম রাজনৈতিক বাস্তবতা
জামায়াতে ইসলামী বারবারই নিজেদেরকে ইসলামী শাসনের ধারক ও বাহক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তারা দাবি করে, ইসলামই মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ এবং কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনাই সত্যিকারের কল্যাণ বয়ে আনবে। খোলাফায়ে রাশেদার শাসনামল এই বয়ানের অকাট্য প্রমাণ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যখনই রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রশ্ন এসেছে, তখন তারা আদর্শের কথা ভুলে গিয়েছেন। একদিকে তারা শরিয়াহ-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দাবি তোলে, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ক্ষমতায় যেতে সচেষ্ট হয়। ইসলামিক খিলাফত বা শূরা-ব্যবস্থার কথা বললেও তাদের দলীয় গঠন, নেতৃত্ব বাছাই, ও রাজনীতির ধরনে গণতান্ত্রিক অথবা ইসলামী কোনোটিই পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিফলিত হয় না।
আরও পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেখা যায় যখন তারা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে — যেমন ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি’র বিরোধিতায় আওয়ামীলীগের সাথে যুগপথ আন্দোলন এবং আবার ২০০১ সালে চারদলীয় জোটে বিএনপির সঙ্গে একই পথের পথিক হওয়া। অথচ আওয়ামীলীগ অনেকেক্ষেত্রেই ইসলাম বিদ্বেষী এবং বিএনপিও কখনো শরিয়াহ ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার দাবিদার ছিল না। এই দ্বিমুখী অবস্থান ইসলাম ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যকার ভারসাম্য নয়, বরং নীতিহীন ক্ষমতালিপ্সার প্রতিফলন।
পাকিস্তানপ্রীতি ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিতা
জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে ভয়াবহ দ্বিচারিতা প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ১৯৭১ সালে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, পাকিস্তানের একতা ও ইসলামী রাষ্ট্র রক্ষার নামে সরাসরি পাকিস্তানের বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয়।
পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতায় টিকে থাকার জন্য তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শামিল হতে চায়।
ধর্মীয় আদর্শের মোড়কে স্বার্থান্বেষী রাজনীতি
জামায়াত সবসময়ই দাবি করে তারা “আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন প্রতিষ্ঠা” করতে চায়। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, তারা ধর্মকে অনেকসময় একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যখন জনমানসে ধর্মীয় আবেগ তুঙ্গে থাকে, তখন তারা ইসলামের ব্যাখ্যা দিয়ে আবেগকে কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু যখন রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আপোস দরকার হয়, তখন সেই একই ধর্মের ব্যাখ্যায় নতুন ফতোয়া ও সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করে। উদাহরণস্বরূপ, তারা নারীর নেতৃত্বকে ইসলামবিরোধী বলে ফতোয়া দেয়, কিন্তু পরবর্তীতে নারী ভোট আকর্ষণের জন্য ‘নারী সম্মান’ প্রচারণা চালায়। তাদের দ্বিচারিতা এতটাই স্পষ্ট যে, একদিকে তারা ইসলামপন্থী দাবি করে, অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থে মুসলিম ও ইসলামবিরোধী কার্যক্রমেও আপত্তি করে না।
গণতন্ত্র ও শরিয়াহর দ্বৈত ব্যাখ্যা
জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কৌশলে সবচেয়ে বিপজ্জনক দ্বিচারিতা দেখা যায় গণতন্ত্র এবং শরিয়াহ নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। দলটি বহুবার গণতন্ত্রকে "ইসলামবিরোধী পশ্চিমা শাসনব্যবস্থা" বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা দাবি করে, ইসলামেই পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা আছে, যেখানে জনগণের শাসনের জায়গায় আল্লাহর শাসনই প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু একই দল যখন নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ব্যবহার করতেই দ্বিধা করে না। ভোটের মাঠে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, জনমতকে পুঁজি করে, এমনকি ইসলামবিরোধী বা নাস্তিক আখ্যা দেওয়া দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করে। এটি এক ভয়ংকর দ্বিচারিতা — একদিকে ইসলামি রাষ্ট্রের দাবি, অন্যদিকে প্রচলিত রাজনীতির সব সুবিধা ভোগ। আরও বড় অসঙ্গতি দেখা যায় সংবিধান বিষয়ে তাদের অবস্থানে। তারা সংবিধানে “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” রাখার পক্ষে, কিন্তু একইসঙ্গে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের বিরোধিতা করে। তারা ইসলামকে ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের মতবাদের প্রচার করতে চায়, কিন্তু অন্য মত বা ব্যাখ্যা অনুমোদন করে না।
বর্তমানে জামায়াতের ভাষা ও কাজের বৈপরীত্য
জামায়াতে ইসলামীর কথাবার্তায় এক ধরনের উচ্চমার্গীয় নৈতিকতা ও ধর্মীয় আবেগ প্রবলভাবে প্রকাশ পায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা বারবার রাজনৈতিক ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় তাদের ভাষা হয় অগ্নিগর্ভ, যেখানে ভিন্নমতের লোকজনকে “ইসলামবিদ্বেষী”, এমনকি “মুরতাদ” পর্যন্ত আখ্যায়িত করা হয়। এই ধরনের ভাষা ব্যবহার ইসলামি সৌজন্য নয় বরং বিভাজনের রাজনীতির ইঙ্গিত দেয়।
সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ও দ্বিচারিতার উদাহরণ
বর্তমান সময়েও জামায়াতে ইসলামী তাদের দ্বিচারিতামূলক অবস্থান থেকে সরে আসেনি। নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্য তারা মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “সফট ইসলামী” ভাবধারা প্রচার করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা কট্টর মতবাদ ও উগ্র হীন রাজনীতিকে লালন করে। অনেক সময় তারা শিক্ষিত, তরুণ প্রজন্মকে ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে, এবং নিজেদের শুদ্ধ ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তারা দ্ব্যর্থপূর্ণ আচরণ করে। এতে বোঝা যায়, তাদের বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট কোনো আদর্শিক অবস্থান নেই, বরং যা সুবিধাজনক, সেটাই তারা গ্রহণ করে।
সমাজে প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
জামায়াতে ইসলামী তাদের দ্বিচারিতার মাধ্যমে সমাজে একধরনের বিভ্রান্তি ও বিভাজনের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। একদিকে তারা ধর্মপ্রাণ মানুষকে প্রভাবিত করে, অন্যদিকে সেই আবেগকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। ফলে সাধারণ মানুষ ইসলামি আদর্শ ও রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের কর্মকাণ্ডে ইসলামের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসলামের নামেই যখন ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার বা দ্বিচারিতা হয়, তখন মানুষ ইসলামের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। ফলে ইসলাম নয়, ইসলামপন্থী রাজনীতির ভুল উপস্থাপন সমাজে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
শেষ কথা শেষ নয়
জামায়াতে ইসলামীর দ্বিচারিতা কেবল একটি রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা নয়, এটি নৈতিক ও আদর্শিক দেউলিয়াত্বের চিহ্ন। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে সত্য, ন্যায়, এবং শুদ্ধতার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড বারবার দেখিয়েছে যে তারা আদর্শ নয়, ক্ষমতাকেই মুখ্য করেছে। তাদের কথায় ইসলাম, কিন্তু কাজে স্বার্থ। মুখে ন্যায়বিচার, কাজে নয়। এ ধরনের দল ইসলামকে ব্যবহার করে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে, যা সমাজ ও রাষ্ট্র; উভয়ের জন্যই ভয়ংকর।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক
আরও পড়ুন: