শনিবার

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
১৩ আশ্বিন, ১৪৩১
২৪ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

গরুর দালাল থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন

প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০

শেয়ার

গরুর দালাল থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন
সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

একসময় পেশায় ছিলেন গরু বেচা-কেনার (মধ্যস্থতাকারী) দালাল। জানা গেছে, এ পেশায় ছিলেন দীর্ঘদিন, সব শেষ ২০০৬ সালে এ পেশা থেকে সরে পুরোপুরি রাজনীতিতে সক্রিয় হোন সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর মাঠের রাজনীতিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামিলীগের টিকেট পেয়ে প্রথমবারের মতো কুড়িগ্রাম-৪ আসন থেকে এমপি হন জাকির হোসেন। এ-থেকেই তার উত্থান শুরু।

এমপি হয়েই প্রবেশ করেন দুর্নীতির মহারাজ্যে। সে-সময় সংসদে বক্তব্য দিতে গিয়ে সড়ক প্রস্থের জায়গায় 'ওসার' (কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা) শব্দটি উচ্চারণ করে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন জাকির হোসেন। সেই ঘটনায় তাকে সংসদ থেকে ৩মাসের ভাষা শেখার জন্য পরামর্শ দেন তৎকালীন স্পিকার। এর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে জাতীয় পার্টি (জেপি) এর সাইকেল প্রতীকের প্রার্থী রুহুল আমীনের কাছে হেরে যান জাকির হোসেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাকায় রফাদফা করে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে দ্বিতীয় বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন জাকির হোসেন। 

স্থানীয়রা জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের শাসনামলে কুড়িগ্রামে প্রথম এবং একমাত্র মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পান জাকির হোসেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়।

এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। এরপর থেকেই তার চেহারা পালটে যায় জাকির হোসেনের। রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী উপজেলায় অবৈধ বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, হাটবাজার ইজারা নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, থানায় মামলা নিয়ন্ত্রণ এবং সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ-সবই হয় প্রতিমন্ত্রীর নামে।

নামে-বেনামে তার ঢাকায় একাধিক বাড়ি, রংপুরে বাড়ি, কুড়িগ্রাম জেলা শহরে বহুতল বাড়ি, রৌমারীতে দুটি বাড়ি এবং রাজীবপুর উপজেলায়ও রয়েছে একটি বাড়ি। চারটি মার্কেট, সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করে ৫টি স্থানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। মিল, চাতাল, খামারবাড়ি-সবই আছে তার। যার মূল্য কয়েক শ কোটি টাকা। 

অভিযোগ রয়েছে রৌমারীর প্রাণ কেন্দ্রে রৌমারী-ঢাকা মহাসড়কের পাশে সরকারি এক একর খাস জমি দখল করে মায়ের নামে নির্মাণ করেছেন শিরি অটো রাইস মিল। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৩০ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়  পার্শ্ববর্তী জেলা জামালপুরের লাউচাপড়া এলাকায় সরকারি ২০ কোটি টাকার বনভূমি দখল করে করা হয়েছে মায়ের মাজার। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সব বরাদ্দে মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট সিন্ডিকেটকে কমিশন না দিলে মেলে না সুবিধা। ভিজিডি, ভিজিএফ, সরকারের ঘর বরাদ্দ, টিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ সব কর্মসূচির টাকা যেতো নেতাদের পকেটে।

জানা গেছে, মন্ত্রীর এবং পরিবারের নামে ও বেনামে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। মন্ত্রীর বাড়ি রৌমারীর মন্ডলপাড়া রূপ নিয়েছিল মন্ত্রীপাড়ায়। সে বাড়ির বর্তমান বাজার মূল্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা। তার আশীর্বাদপুষ্ট সিন্ডিকেটের অন্তত ১১ জনের বহুতল বাড়ি রয়েছে বলে দলের নেতারাও অভিযোগ তুলেছিলেন।

সম্পদ ও জমি দখল:  রৌমারী সদর ইউনিয়নের তুরা রোডে সড়ক ও জনপথের (সওজ) ৭০ শতাংশসহ ব্যক্তিমালিকানার জমি দখল করে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। এ প্রতিষ্ঠানের বাজার মূল্য ৩৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালের এপ্রিলে এই দখলের কয়েক মাস পর রাতের আঁধারে সেই সাইনবোর্ড উধাও হয়ে যায়। পরে সেখানে প্রতিমন্ত্রীর ছেলে সাফায়াত বিন জাকির নিজস্ব পাথরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। তবে সওজ এর জায়গা দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার বিষয়ে কুড়িগ্রাম সওজ এর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ভুক্তভোগীরা আরও অভিযোগ করে বলেন, সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের নামে রৌমারীর চরশৌলমারী ইউনিয়নের ঈদগাহ মাঠ নামক স্থানে প্রায় আড়াই একর জায়গা অধিগ্রহণের জন্য নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সেই জায়গা দখল করে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্টের প্রায় দুই কোটি টাকার জায়গা এখন মন্ত্রীর দখলে। একইভাবে তুরা রোডের গুচ্ছ গ্রামে ১৫ শতাংশ, পাশে ২১ শতাংশ ও অপর এক স্থানে ৫০ শতাংশসহ প্রায় দুই একর জায়গা দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন জাকির হোসেন। এসব জমির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। 

কর্তিমারী বাজারের সোনালী ব্যাংক সংলগ্ন ১নং খাস খতিয়ানের ৪ কোটি টাকা মূল্যের ৩২ শতক জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে মার্কেট। রাজীবপুর উপজেলার শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম সংলগ্ন ২ কোটি টাকার সরকারি পুকুরের ২০ শতাংশ জমি দখল করে নির্মাণ করেছে দোকানঘর। রাজীবপুর শিশু পার্ক এলাকায় রয়েছে একতলা বাড়ি যার দাম ২ কোটি টাকা। এছাড়াও বন্দবেড় ইউনিয়নের কুটিরচরে এক একর, দইখাওয়া এলাকায় (৮ কোটি টাকা দামের) ৫ একর, উপজেলার দাঁতভাঙ্গা বাজার এলাকায় ১ একর সরকারি জায়গা দখল এবং সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভরাট করে  আরব আলী বাবার মাজার’ নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।

তারা জানায় এ মার্কেটের বর্তমান দাম ১০ কোটি টাকা। ইছাকুড়ি মহিলা মাদ্রাসা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোসহ জায়গা দখল করে মন্ত্রী  জাকির হোসেন গড়ে তোলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’। এই প্রতিষ্ঠানের মূল্যও ২ কোটি টাকা। সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের লন্ডনে রয়েছে রাজকীয় বাড়ি যা বাংলাদেশি টাকায় ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। সেখানে বর্তমান থাকছেন তার একমাত্র মেয়ে সঞ্চয়া জাকির। চিলমারী উপজেলায় শশুর ও স্ত্রীর নামেও রয়েছে তার কয়েক কোটি টাকার সম্পদ।

মাদক পৃষ্ঠপোষকতায়: স্থানীয়রা জানান, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হলেও তিনি মাদক সংশ্লিষ্টতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের তালিকায় (গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্টের ভিত্তিতে) মাদকের পৃষ্ঠপোষক’ হিসাবে নাম আসে তার। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিমন্ত্রীর পারিবারিক মাইক্রোবাসে ইয়াবা নিয়ে যাওয়ার সময় ইয়াবাসহ গাড়িচালক রফিকুল ইসলামকে আটক করে র‌্যাব-১৪-এর একটি দল। জাকির হোসেনের সঙ্গী সেকেন্দার বাবলুও গাঁজাসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন।

সর্বশেষ তিনি আওয়ামিলীগ সরকার পতনের পর ৭ আগস্ট রাতে ভারতে পালাতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ এর ধাওয়া খেয়ে বর্তমানে দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের অবৈধ সম্পদ বায়েজাপ্তসহ   তার সহযোগিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।