শুক্রবার

২২ নভেম্বর, ২০২৪
৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১
২০ জামাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর আজ: ২০০৬ সালের এই দিনে যা ঘটেছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:৩৭

শেয়ার

রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর আজ: ২০০৬ সালের এই দিনে যা ঘটেছিল
ফাইল ছবি

রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর আজ। ২০০৬ সালের এই দিনে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রকাশ্যে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ছয় নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন রাজপথে দিনভর ব্যাপক তাণ্ডব চালায় আওয়ামী লীগ। রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার পর সেই লাশের ওপর নৃত্যের ঘটনাটি দেশের ইতিহাসে একটি অন্যতম নৃশংস ঘটনা, যা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠে দেশে-বিদেশে।

সেদিন বিষয়টি হঠাৎ করে ঘটেনি। আগেই লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে এসে প্রতিপক্ষকে দমনের ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কে এম হাসান যদি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয় তাহলে সারাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যাতে লগি-বৈঠা হাতে ঢাকায় চলে আসে।

কি ঘটেছিলো সেই দিন:

বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শাসনামল ২০০১-২০০৬। এই শাসনামল শেষে সংবিধান অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে চারদলীয় জোট। সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন সর্বশেষ বিদায়ী প্রধান বিচারপতি। প্রধানবিচারপতি হিসেবে কে এম হাসানের বয়স বাড়ানো হলো। অবসরের পর তিনিই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। দেশের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়ানোর বিরোধিতা শুরু করলো। কে এম হাসানকে বিএনপির লোক আখ্যায়িত করে তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে না নেয়ার ঘোষণা দিল আওয়ামী লীগ। তার আগে থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বিচারপতি এম এ আজিজকে গ্রহণ করতে পারছিল না তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য বামপন্থী সকল দলকে সাথে নিয়ে গঠন করলো ১৪ দলীয় মহাজোট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করে।

একের পর এক হরতাল অবরোধ পালন করতে থাকে। একদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজকে সরানোর আন্দোলন অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কে এম হাসানকে মেনে না নেয়ার আন্দোলন। তৎকালীন বিরোধী দলের আন্দোলন সরকারের কাছ থেকে কোন দাবীই আদায় করতে পারেনি। এক পর্যায়ে তাদের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলন আরো বেগবান হতে থাকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগের দাবীতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ঘেরাও করা হয়। সারাদেশে পালন করা হয় হরতাল ও অবরোধ। এক পর্যায়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ’০৬ পল্টনের মহাসমাবেশ থেকে তৎকালীন বিরোধী দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন লগি-বৈঠা-লাঠি নিয়ে ঢাকায় আসার জন্য। নেতাকর্মীদের বুঝতে বাকি রইল না- কী করতে হবে তাদের। চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ই দেশে শুরু হয় অরাজক ও বিশৃঙ্খল অবস্থা।

এক অজানা উৎকণ্ঠায় সারাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। পবিত্র মাহে রমজানের পর ঈদ-উল ফিতরের আনন্দ উৎসবের রেশ তখনও বিদ্যমান। দেশে যে গণতান্ত্রিক সুন্দর ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় ঈদের ৩ দিন পরই চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কেয়ারটেকার সরকারের কাছে। শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন এ ঐতিহাসিক মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছে, সে সময়ই এক অজানা আশঙ্কা ভর করেছে সবার মনে। ঢাকা শহরে এক অদ্ভুত থমথমে নীরবতা, গ্রাম-গঞ্জে আটকেপড়া শহরমুখী মানুষ এক অবর্ণনীয় দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে টিভি এবং রেডিওর সামনে কি অবস্থা দেশের? রেওয়াজ অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে এম হাসানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে চারদলীয় জোট সরকার। কিন্তু সেদিন তা আর সম্ভব হলো না। ২৭ অক্টোবর রাত থেকেই পরিকল্পিতভাবে সারাদেশে সৃষ্টি করা হলো এক চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। সেই পুরনো দৃশ্য ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট ও সড়ক অবরোধ।

পরদিন ২৮ অক্টোবর, সব জায়গায় থমথমে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, টিভি চ্যানেলে যখনই কোন সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কী পরিস্থিতি তা জানার জন্য। অবরোধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের নেতকর্মীরা লগি-বৈঠা-লাঠি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ফলে হঠাৎ করেই দেশে নেমে আসে চরম নৈরাজ্য। রাজপথ ও সভাস্থল দখলের নামে আওয়ামী লীগ আক্রমণ করে জামায়াত ও জোট নেতাকর্মীদের ওপর, শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। অত্যন্ত সুকৌশলে দেশকে ঠেলে দেয়া হয় অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার দিকে, যার সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ জনগণ। বিকেল এবং সন্ধ্যায় প্রায় সবকটি টিভি চ্যানেলে যখন সচিত্র সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছিল কোটি কোটি মানুষের চোখ তখন স্থির। ঢাকার পল্টন মোড়ে এ কি লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখছে তারা? লগি, বৈঠা, কিরিচ, লাঠি ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একদল উন্মত্ত মানুষ কিভাবে নির্বিচারে অত্যাচার চালাচ্ছে আরেকদল মানুষের ওপর। কিভাবে পিটিয়ে, খুঁচিয়ে আঘাতের পর আঘাতে জীবন্ত যুবকদের হত্যা করছে, হত্যার পর মৃত লাশের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাসনৃত্য করছে। পুলিশের সামনেই মুহুর্মুহু গুলী ও বোমা ফাটিয়ে শত শত বনি আদমকে আহত করছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাজপথ। উহ্! এ দৃশ্য দেখে মূর্ছা গেছেন অনেক মা-বোন, কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মানবিক চেতনাসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ। গণতান্ত্রিক সভ্যতার যুগে এ কেমন ভয়ঙ্কর রূপ! সদ্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া বাংলার কতিপয় মানুষের এ কেমন খোলস?

সেদিন শুধু রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে জামায়াত-শিবির কর্মীরা আওয়ামী লীগের বর্বোরচিত হামলার শিকার হন। অনেকের বাড়িঘর দখল করে নেয়া হয়, কারো বাড়ি আর সহায়-সম্পত্তিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়, কারো হাত কেটে নেয়া হয়, আবার কারো চোখ উপড়ে ফেলা হয়। আর এভাবেই জামায়াতে ইসলামীসহ জোটের ৪ সহস্রাধিক নেতাকর্মী আহত হন। যার মধ্যে অসংখ্য সাধারণ মানুষও রয়েছে। তৈরি হয় লাশের স্তুপ। জামায়াতে ইসলামীর ১৩ জনসহ মোট ২৬টি লাশ ঝরে পড়ে।