শনিবার

১৯ এপ্রিল, ২০২৫
৬ বৈশাখ, ১৪৩২
২১ শাওয়াল, ১৪৪৬

লন্ডন বৈঠকে বরফ গলছে বিএনপি জামায়াতের: নির্বাচন ইস্যুতে প্রায় একই সুর

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ ০৯:৪৬

শেয়ার

লন্ডন বৈঠকে বরফ গলছে বিএনপি জামায়াতের: নির্বাচন ইস্যুতে প্রায় একই সুর
নির্বাচন ইস্যুতে প্রায় একই সুর।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে চলছে নানা সমীকরণ। এর মধ্যে সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক নিয়ে জনমনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে, যা এখন রাজনীতির আলোচিত ইস্যু। বিশেষ করে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে হঠাৎ জামায়াতের অবস্থান বদল ও বিএনপির দাবির কাছাকাছি আনা-এ বৈঠকের ফল কিনা তা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ। তবে লন্ডনের বৈঠকে দুদলের সম্পর্কে যে বরফ গলছে তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে জামায়াত নেতাদের বক্তব্য থেকেই। কিন্তু সেই সম্পর্ক সামনের দিনে কোনো নির্বাচনি ‘সমঝোতা’ বা ফের ‘জোট’ গঠনের দিকে যাবে কিনা-তা নিয়েও নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিষয়টি ধারণা ও গুঞ্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। যুগান্তরকে এমনটিই জানিয়েছে দল দুটির একাধিক সূত্র।

বিএনপিসহ মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সংসদ নির্বাচনের দাবিতে অনড়। বুধবারও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও একই দাবি জানিয়েছে বিএনপি।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলে আসছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তারপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অবশ্য এখন দলটি বলছে, তারা আগামী রমজানের আগেই সংসদ নির্বাচন চায়। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দলটির দাবিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, এখন নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান থেকে জামায়াতের দূরত্ব কমতে শুরু করেছে। বলা যায়, এক সময়ের জোটমিত্র জামায়াত শিগগির আরও কাছাকাছি পৌঁছে সরল রেখায় চলে আসতে পারে।

আগামী বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারির (চাঁদ দেখা সাপেক্ষে) পর রমজান শুরু হবে। তার আগেই নির্বাচনের পক্ষে জামায়াত। বৃহস্পতিবার জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নির্বাচনের আগে দৃশ্যমান গ্রহণযোগ্য মৌলিক সংস্কার, গণহত্যাকারীদের দৃশ্যমান বিচার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধ-এই তিনটি শর্ত পূরণের কথা জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপির নেতারা বলেন, এটি বিএনপিসহ মিত্ররাও চায়। অর্থাৎ তাদের দাবি প্রায় একই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে মিল ছিল না জামায়াতের অবস্থান। তবে নির্বাচন ইস্যুতে দুদলের অবস্থান এখন কাছাকাছি চলে আসার বিষয়টি হওয়া লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াত আমিরের বৈঠকের ফল হতে পারে। ওই বৈঠক যদি ফলপ্রসূ হয় আগামী দিনে আরও কিছু তৎপরতা দেখা যেতে পারে, যা দুদলকে আরও কাছাকাছি এনে দেবে। এতে করে সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন রাজনৈতিক দলের চাওয়া অনুযায়ী হবে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে জানি না। তবে মনে হচ্ছে, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনার ফলেই এ দুদলের মধ্যে দূরত্বটা কমে যাচ্ছে। মূলত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনার পরই বিষয়টি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, এই দুদলের দূরত্বের ফলে বাংলাদেশ একটি গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে চলে যাচ্ছিল। এখন বিএনপি আর জামায়াতের মধ্যে যদি দূরত্ব কমে আসে, তাহলে সংসদ নির্বাচনও এগিয়ে আসবে। একই সঙ্গে দেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের জোট গঠনের বিষয়টি এখনো বলা যায় না। কোন ধরনের জোট হবে বা হবে না, তার অনেক কিছু নির্ভর করবে সামনে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনীতি কোন দিকে যাবে সেই পরিস্থিতির ওপর। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর বহু বিদেশি শক্তির প্রভাব আছে। তাই জোট গঠনের বিষয়ে এখনই কোনো স্বচ্ছ ধারণা করা সম্ভব নয়।

রোববার লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের বৈঠককে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলছে দুদল। এ নিয়ে জামায়াতের আমির কথা বললেও এখন পর্যন্ত বিএনপির কোনো নেতা কথা বলেননি। বিএনপির একটি সূত্র বলছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে রাজনীতি, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে। তবে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে আলোচনা হয়নি। দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়েও ওই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তৃতীয় পক্ষ যেন কোনো ধরনের সুযোগ নিতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক অবস্থানের বিষয়ে আলোচনা হয়। বিএনপি নেতাকর্মীরা নানা অপকর্মে যুক্ত এমন অপপ্রচার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণার জন্য জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অভিযোগ করা হয়। যদিও জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বলা হয়, এগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত নয়। ২২ বছর বিএনপির সঙ্গে রাজনীতি করেছে জামায়াত। দলটি বিএনপির শত্রু নয়।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নয়, বিভিন্ন বিষয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর মতো বিএনপিও জুলুমের শিকার হয়েছে। এই দেখা করার মূল উদ্দেশ্য তার (খালেদা জিয়া) খোঁজখবর নেওয়া। উনারা তাদের অতি সম্মান ও ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করেন। যেহেতু তিনি তার ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বাসায় অবস্থান করছেন, কাজেই তিনিও (তারেক রহমান) সেখানে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তিনিও ছিলেন। দুদলের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এক জায়গায় বসলে সেখানে রাজনীতির কথা হবে না, এটা কি বাস্তব! বাস্তব নয়। কথা তো হয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে, বিচার প্রক্রিয়া কীভাবে হবে, না হবে-বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।

জামায়াতের আমির বলেন, রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু সেটা যেন মতবিরোধে রূপ না নেয়। আমরা চাই মতপার্থক্য থাকুক, নয়তো রাজনীতিবিদরা অন্ধ হয়ে যাবেন। কিন্তু এও প্রত্যাশা করি, এটি যাতে মতবিরোধে রূপ না নেয়। ওটা পার্থক্য পর্যন্ত থাকুক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনীতিবিদরা অনেক সময় বিষয়গুলো খেয়াল করেন না বা করি না। এটা করতে হবে। যদি আমরা দেশকে ভালোবাসি, তাহলে এই ভালোবাসার, শ্রদ্ধার জায়গায়, মিউচুয়াল রেসপেক্টের জায়গায় আসতে হবে।

বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, কারও সঙ্গে জোট গঠন বিষয়ে সাধারণত আলোচনা শুরু হয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর। এবার পরিস্থিতি আরও ভিন্ন। এবার জোট গঠন নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি মাঠে থাকা না থাকার ওপরও। এছাড়া বিএনপির হাইকমান্ড আগেই ঘোষণা দিয়েছেন জনগণের ভোটে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিল এমন সব রাজনৈদিক দল নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হবে। সেজন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই কাজ করছে বিএনপি।

শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়া ও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এক সময়ের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির প্রধান নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বী হতে জামায়াত ভোটের মাঠে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। দল দুটির নেতারা পরস্পরের কড়া সমালোচনা করছেন। প্রায় সব ইস্যুতে দল দুটির অবস্থান বিপরীতমুখী। শুধু কথার লড়াই আর বাহাস নয়, দল দুটির নেতাকর্মী বিভিন্ন স্থানে সংঘাতেও জড়িয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র নেতারাও জামায়াতকে ব্যাংক দখলকারী, মোনাফেক বলে আখ্যা দেন। এর প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াত নেতারা বিএনপি নেতাকর্মীকে চাঁদাবাজ, দখলদার আখ্যা দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে রোববার খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু মনে করেন, নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের পেছনে লন্ডনের বৈঠকের একটা প্রভাব তো থাকতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তারা গণতন্ত্রের পক্ষে ভূমিকা নেওয়ায় তাদের রাজনীতি, সংগঠন ও সংগ্রামকে দেশবাসী ইতিবাচকভাবেই নেবে।

১৯৯৯ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয় জামায়াত। একসঙ্গে সরকার পরিচালনা করা দল দুটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জোট থেকে বেরিয়ে আসে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে যুগপৎ আন্দোলন করে। শেখ হাসিনার পতন ঘটানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দুটি দলের নেতাকর্মীদেরই সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল। ৬ আগস্ট খালেদা জিয়া কারামুক্ত হওয়ার পর জামায়াত নেতারা তাকে দেখতে যান হাসপাতালে।

 

banner close
banner close