
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন কোনো সমাধান নয়। এর সমাধান হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসন। সে জন্য আরাকানকেন্দ্রিক স্বাধীন আরাকান মুসলিম স্টেট চায় জামায়াতে ইসলামী।’
রবিবারর বিকেল ৫টায় হোটেল ওয়েস্টিনে সফররত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলের মতবিনিময়সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে নতুন স্বাধীন আরাকান স্টেট গঠনের প্রস্তাবনা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
মতবিনিময়সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমাদের বেশ খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে চায়না সরকারের আমন্ত্রণে আমরা একটি প্রতিনিধিদল সেখানে গিয়েছিলাম। ওই সফরটা অনেকটা সরকারি ছিল, তবে আজ আমাদের যে বৈঠকটা হলো পার্টি টু পার্টি।
তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের এই অঞ্চলে নয়, পুরো বিশ্বে চীন একটি অ্যামার্জিং ফোর্স। রাজনীতি, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে চীনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াতে ইসলামী যেহেতু ইনক্লুসিভ ডেমোক্রেটিক, লিবারেল পার্টি; আমাদের প্রধান পলিসি হচ্ছে, সবার সাথে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে সুসম্পর্ক করা। সে হিসেবে আমরা চায়না কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।
সাবেক এ সংসদ সদস্য বলেন, ‘তারা আমাদের প্রধান উপদেষ্টাকে দাওয়াত দিয়েছেন। কতিপয় চুক্তি করেছেন, আশ্বাস দিয়েছেন, সে জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি। বাংলাদেশে এখন চীন হচ্ছে প্রধান বিনিয়োগকারী। সেটা আমরা আরো অনেক পরিসরে বাড়াতে অনুরোধ করেছি।
তিস্তা ব্যারাজ ও দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে উল্লেখ করে ডা. তাহের বলেন, ‘আমরা তিস্তা ব্যারাজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট করে বলেছি। দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর জন্য বিনিয়োগ করার কথা বলেছি। গভীর সমুদ্রে যে বন্দর হচ্ছে সেখানে অর্থায়ন করার কথা বলেছি। গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আমাদের যে ব্লু ইকোনমি, সেটা আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে কথা হয়েছে। এই অঞ্চলে যাতে করে কেউ কারো প্রতি রক্তচক্ষু দেখাতে না পারে, ভারসাম্যমূলক নিরাপত্তাব্যবস্থার ব্যাপারে আমরা তাদের সাথে আলোচনা করেছি এবং বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকভাবে ছাত্রদের স্কলারশিপ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। এসব বিষয়ে তারা আমাদের সাথে ঐকমত্য হয়েছেন। তারা তাদের সরকারকে এ ব্যাপারে অবহিত করবেন এবং প্রয়োজনে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘চায়না কমিউনিস্ট পার্টি এবং সরকার বলতে একই সত্তা। সুতরাং আমরা আশা করি চীন সরকারের সঙ্গে গভর্মেন্ট টু গভর্মেন্ট, জামায়াতে ইসলামী টু চায়না গভর্মেন্ট, পিপলস টু পিপলস এবং পার্টি টু পার্টি সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পাবে। তারা তাদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে দাওয়াত দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমরাও জামায়াতের পক্ষ থেকে চায়না কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশ সফর করার জন্য আমন্ত্রণ জানাব বলেছি, যেটার হোস্ট হবে জামায়াত।’
জামায়াতের এ শীর্ষ নেতা বলেন, জামায়াতে ইসলামীর জন্য চায়না কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আজকের এই বৈঠক আমরা একটি সুযোগ বলে মনে করি। কারণ চায়না সরকার বা চায়না কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের খুব একটা ইন্টারেকশন ছিল না। কিন্তু এটি এখন অনেক ব্যাপকভাবে হচ্ছে। খুব দ্রুততার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বা ইন্টারেকশন বৃদ্ধি পেয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুকে বাংলাদেশের জন্য সমস্যা উল্লেখ করে সমাধানে একটি আলাদা স্বাধীন মুসলিম আরাকান স্টেট গঠনের প্রস্তাবনা তুলে ধরে তাহের বলেন, আমরা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। ১১ বা ১২ লাখের রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে, তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমরা বলেছি, এভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবেতর অবস্থান কোনো সমাধান নয়। সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসন করা। সে জন্য আমরা একটি প্রস্তাবও দিয়েছি, সেটি হচ্ছে আরাকানকেন্দ্রিক রোহিঙ্গা মেজরিটি যে এরিয়া আছে, সেই এরিয়াতে একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট আরাকান স্টেট করার। এখানে চীন অনেক বেশি বা বড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের খুবই ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
ডা. তাহের বলেন, যদি ইন্টারন্যাশনাল একটি রিপ্যাট্রিয়েট কমিটি থাকে, তাহলে সকলে মিলে এখানে সমস্যা সমাধান করতে পারবে। আমরা বলেছি, সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে একটি মুসলিম আরাকান স্টেট গঠন করতে। এই প্রস্তাবে চায়না কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদল বলেছে, তারা এই প্রস্তাব চীন সরকারের কাছে উত্থাপন করবে এবং এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করার চেষ্টা তারা চালাবে।
চলমান সংস্কার প্রস্তাবনা ও নির্বাচন বিষয়েও চায়না কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর এ সিনিয়র নায়েবে আমির বলেন, সংস্কার নিয়ে তারা কথা বলেছেন। সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের যে পয়েন্টগুলো ছিল, সেগুলো আমরা বলেছি। গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে, সেখানে দিনব্যাপী আলোচনা হয়েছে। এটা অব্যাহত আছে, আমাদের হয়তো আরও দুদিন সময় লাগতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সরকার প্রসঙ্গ নয়। চায়না কমিউনিস্ট পার্টি তথা চীন সরকার তো আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছে, দাওয়াত দিয়েছিল, চুক্তিও করেছে। রিলেশনশিপ যদি আমরা মেইনটেইন করতে পারি, তাহলে তাদেরও লাভ, আমাদেরও লাভ। এখনকার ফরেন পলিসি বা ফরেন ইনভেস্টমেন্ট তো মিউচ্যুয়াল ইন্টারেস্টের জায়গা থেকেই। আর তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশের নির্বাচন কবে, কীভাবে হতে পারে? আমরা বলেছি, আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তো একটা লাইন দিয়েছেন যে, নির্বাচন ডিসেম্বরে হতে পারে, বেশি সংস্কার চাইলে আগামী জুনে হতে পারে। আমরা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টার এই প্রস্তাবের ব্যাপারে আমরা ঐকমত্য পোষণ করি।
চায়না কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদল নির্বাচন সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো মতামত দেননি। তারা বলেছেন, আমরা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না, বাংলাদেশের বিষয়েও আমরা হস্তক্ষেপে বিশ্বাস করি না। আমাদের কাজ হচ্ছে আপনাদের প্রোগ্রাম ও পলিসির বিষয়ে সহযোগিতা করা।
মত বিনিময়সভায় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন।
আরও পড়ুন: