মঙ্গলবার

২৯ এপ্রিল, ২০২৫
১৫ বৈশাখ, ১৪৩২
১ জিলক্বদ, ১৪৪৬

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বনাম ইসলাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ ১১:৪৭

আপডেট: ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ ১৭:৪৫

শেয়ার

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বনাম ইসলাম
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বনাম ইসলাম

মুমিন নারী প্রশান্তির প্রস্রবণের মতো, যা মলিনতা ও একাকিত্ব মুছে দেয় এবং প্রাণে সঞ্চিত করে প্রেমময়তা। এ মহান অনুভূতি রব কর্তৃক মনোনীত, যা পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় সুসজ্জিত। গোটা পৃথিবী পারিবারিক ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর ব্যতিক্রম যেখানেই হচ্ছে, সেখানে অশ্লীলতার অতলে চলে যাচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজ। ভেঙে যাচ্ছে স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা।

ইসলামে একজন নারীর মর্যাদা দুনিয়ার তাবৎ ঐশ্বর্যের চেয়ে বেশি। একজন নারী মা হয়ে জন্ম দেন উম্মাহর একেকটা সম্পদ। স্ত্রী হয়ে পুরুষের সমস্ত মহান কর্মের সারথি হন। ইসলামের ইতিহাসে মহান নারীদের জীবনী জান্নাতি নারী হয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হওয়ার এক সমুজ্জ্বল উপাখ্যান। পশ্চিমারা আমাদের মন ও মস্তিষ্কের নার্ভগুচ্ছে চালাচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন, যার ফলস্বরূপ প্লে করা হয়েছে নতুন সুপারিশমালা। বেসরকারি সংস্থা ‘নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে গত ১৮ নভেম্বর নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এখানে ৪৩৩টি সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। এই সুপারিশমালায় ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামি পারিবারিক আইনকে নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ হিসেবে মোটাদাগে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ছাড়া এমন কিছু গর্হিত বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে, যা সমাজকে অনিশ্চয়তা ও চরম অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে। সুপারিশমালার ২৫ পৃষ্ঠায় মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পত্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন মূলত আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত উত্তরাধিকার বিধান দ্বারা রচিত। এটিকে বাতিল করার অর্থ সরাসরি কোরআনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, যা সুস্পষ্ট শরিয়তের অবমাননা।

মানবসমাজে নারী প্রগতির গোড়াপত্তন করে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন রাসুল (সা.), সাইয়েদুল মুরসালিন নারী জাতির মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক জীবন্ত আদর্শ স্থাপন করেছেন। ইসলামে নারীর স্বাধীন মত প্রকাশের মৌলিক বাক-স্বাধীনতা আছে। নর-নারী উভয়ে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে স্বীকৃত এবং কর্মফল অনুযায়ী চিরস্থায়ী জান্নাত লাভের সম-অধিকার প্রাপ্য। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী হোক জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সুরা মুমিন : ৪০)।

ইসলামে কোরআনের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস হাদিস। সেই হাদিসগুলোর মধ্যে আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত ২ হাজার ২২০টি হাদিস কেবল তাঁর একক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে বিশুদ্ধতার সব বিবেচনায় উত্তীর্ণ। দৃশ্যত নারী-পুরুষের যে কথিত বৈষম্যের বুলি শোনানো হয়, তা আদৌ লিঙ্গবৈষম্যের জন্য নয়, বরং তা ইসলামের বিবেচনায় সমাজে নারী ও পুরুষের প্রকৃতি ও ভূমিকার পার্থক্যের দরুন।

ইসলামে নারী-পুরুষের মর্যাদা ও অধিকার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসলাম নারীকে পুরুষের সম-অধিকার নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি দিয়েছে। নারীকে অধিক মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে নারীদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি সুরা নাজিল করেছেন, তা হলো ‘সুরা নিসা’। এখানে নারী অধিকার বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নারীদের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন করো। অতঃপর তোমরা যদি তাদের অপছন্দ করো, তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা এরূপ জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহতায়ালা প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : ১৯)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে সহস্র বছরের ইসলামি শাসনামলেও নারীরা জ্ঞানচর্চা থেকে শুরু করে যে আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ভোগ করেছে, তা আজকের বিংশ শতাব্দীতেও বিরল। জ্ঞানচর্চা, বিয়েশাদি ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র—সবখানে ছিল নারীর সদর্প পদচারণা।

নারী কমিশনের দ্বিতীয় সুপারিশ হলো সকল ধর্মের জন্য একক পারিবারিক আইন চালু করা। এর অর্থ হচ্ছে, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান সবার পারিবারিক আইনকে বাতিল করে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আইন চাপিয়ে দেওয়া। এটি শুধু ইসলাম নয়, বরং হিন্দু-খ্রিষ্টানসহ অন্য ধর্মের বিরোধী। এটি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মত্যাগকে উৎসাহিত করার কৌশল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জুলাই বিপ্লবের রক্তের ওপর। এই রক্তে হিজাব পরা ধার্মিক নারী থেকে নিয়ে সব ধর্মের নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তো এই যে ধর্মনিরপেক্ষ নারী কমিশন, তারা কি সেই নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে?

এই রিপোর্টের পরতে পরতে জেন্ডার আইডেনটিটি তথা সমকামিতার ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, শব্দের মারপ্যাঁচ দিয়ে এখানে মূলত এলজিবিটি আনা হয়েছে। এ সুপারিশের পৃষ্ঠা ৯-এ বলা হয়েছে, নারী-পুরুষকে পরিবারে অভিন্নভাবে দেখতে। এর মানে পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এটি মূলত পশ্চিমা ‘জেন্ডার সমতা’ ধারণার প্রতিফলন। ইসলাম নারী ও পুরুষের মাঝে দায়িত্ব ও ভূমিকার স্বাতন্ত্র্য রেখে সম্মান ও মর্যাদার সমতা দিয়েছে। ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করে না, তবে তাদের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্ব অনুযায়ী ভিন্নতা স্বীকার করে। এ বিধান ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। আল্লাহ বলেন, পুরুষেরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল, কারণ আল্লাহ একের ওপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তারা নারীদের জন্য ব্যয় করে।’ (সুরা নিসা : ৩৪)

নারী কমিশনের প্রথম বিতর্কিত সুপারিশটি হলো মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পত্তি প্রদানের আহ্বান। অথচ ইসলামে উত্তরাধিকার বণ্টন আল্লাহ কর্তৃক সুনির্ধারিত। ইসলাম নারীকে সুস্পষ্টভাবে সম্পত্তির অধিকার দিয়েছে। এরপর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর আর্থিক দায়িত্ব পুরুষের ওপর অর্পণ করেছে। একজন নারী তার বাবা, স্বামী, ভাইয়ের ঘরে কোনো অবস্থাতেই আর্থিক দায়ভার বহন করে না।

এ সুপারিশের পৃষ্ঠা ২৫ এ মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিলের প্রস্তাবটি আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে সরাসরি ধৃষ্টতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী। উত্তরাধিকার বিষয়ে পুরুষের অধিক অংশ কোনো বৈষম্য নয়, বরং তা দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ন্যায়বিচার।

বর্তমানে দেশে নৈতিকতার অভাবে অনেক সমস্যা চলছে। সেই প্রেক্ষাপটে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে সামাজিক শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির কর্তব্য ছিল। সুপারিশমালায় সেটিই আসা উচিত ছিল। অথচ এই সুপারিশমালা এমনভাবে সাজানো ও উপস্থাপন করা হয়েছে, যা আমূলে কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ন্যক্কারজনক কটাক্ষপূর্ণ সুপারিশমালা পবিত্র কোরআনের বিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং ইসলাম ও মুসলিম অস্তিত্বের ওপর একটি পরিকল্পিত আঘাত। এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে দেশের ধর্মীয় ভারসাম্য, পারিবারিক কাঠামো ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করার নীলনকশা সামনে চলে এসেছে ।

আমরা দায়িত্বশীল নাগরিক ও প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হিসেবে অনতিবিলম্বে প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি জানাই—অতিসত্বর এই কমিশনের সদস্যদের বরখাস্ত করে জুলাই বিপ্লব ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন যোগ্য ও উপযুক্ত নারী সদস্যদের মাধ্যম কমিশন পুনর্গঠন করুন এবং ইসলাম যে নারীর ভারসাম্যপূর্ণ দায়িত্ব ও অধিকার দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করে সত্যিকার সোনার বাংলাদেশ গঠনে এগিয়ে আসুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

 

banner close
banner close