কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি খাতে প্রতিযোগীতা দিন দিন আরও প্রবল হচ্ছে। চীনের এআই ল্যাব ডিপসিক সম্প্রতি নিজেদের ওপেন-সোর্স বা উন্মুক্ত এআই মডেল ‘আর১’ (আর ওয়ান) নিয়ে আসার পর এআই’র মাঠ আরও সরগরম হয়ে উঠেছে। এবার তাই বাধ্য হয়েই ওপেন-সোর্স বা উন্মুক্ত এআই প্রযুক্তির কথা ভাবতে শুরু করেছে চ্যাটজিপিটি নির্মাতা ওপেনএআই। সম্প্রতি এমনটাই জানালেন ওপেনএআই’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও স্যাম অল্টম্যান।
অল্টম্যান মনে করেন, ওপেনএআই’র উচিত নিজেদের এআই প্রযুক্তির কিছু অংশ ওপেন-সোর্স বা উন্মুক্ত-সোর্সে নিয়ে আসার বিষয়টি বিবেচনা করা। শুক্রবার রেডিট ফ্রাইডে’র ‘আস্ক মি অ্যানিথিং’ সেশনে উপস্থিত ছিলেন এক অংশগ্রহণকারীর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, মালিকানাধীন মডেলের পরিবর্তে তাঁর প্রতিষ্ঠানের (ওপেনএআই’র) উচিত ভিন্ন একটি ওপেন-সোর্স কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
শুধু তাই নয়, তিনি এও বলেছেন যে, ওপেনএআই’র কর্মীদের অনেকেই তাঁদের প্রযুক্তির কিছু অংশ উন্মুক্ত করার সম্ভাবনা নিয়ে ইতোমধ্যেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছেন। তবে কর্মীদের সবাই এমনটা ভাবছেন, বিষয়টি এমন নয়, এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারও এটি নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, তৈরি ও ব্যবহারের খরচের দিক থেকে ডিপসিকের আর১ মডেলটি ওপেনএআই-এর তৈরি বিভিন্ন মডেলের তুলনায় অনেক বেশি সাশ্রয়ী। তাঁদের জিপিটি-০৪ মডেলটি তৈরিতে যেখানে ১০০ মিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হয়েছে সেখানে মাত্র ৫.৬ মিলিয়ন ডলার হয়েছে আর১ মডেলটি তৈরিতে। অথচ পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে প্রচলিত উন্নত এআই মডেলের প্রায় সমকক্ষ আর১। স্বাভাবিকভাবেই তাই ডিপসিকের চ্যাটবট দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি বিশ্বে।
ডিপসিকের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এটি ওপেন-সোর্স, অর্থাৎ যেকেউ চাইলে প্রয়োজন অনুযায়ী একে কাস্টমাইজ করে নিতে পারেন একেবারে বিনামূল্যে। বর্তমানে প্রচলিত উল্লেখযোগ্য এআই প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রায় সবই মালিকানাধীন বা প্রোপ্রাইটারি মডেল। এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে মেটার তৈরি লামা এআই মডেলগুলো- যেগুলো আংশিক উন্মুক্ত। অর্থাৎ,নির্দিষ্ট লাইসেন্সের অধীনে লামা মডেলগুলো উন্মুক্ত হলেও এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
২০১৫ সালে অ-লাভজনক বা নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরুর সময় ওপেনএআই বলেছিল যে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে তাঁরা তাঁদের গবেষণা ও ডেটা পাবলিক ডোমেইনে উন্মুক্ত করে দিবে। ২০২২ সালের নভেম্বরে ওপেনএআই তাঁদের চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি রিলিজ করার পর এটি দ্রুতই জনপ্রিয় হতে শুরু করে। চ্যাটজিপিটি’র প্রভাবে জেনারেটিভ এআই ভিত্তিক বিভিন্ন টুল ও ফিচারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বর্তমানে শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবকটি’রই বিনিয়োগ রয়েছে এআই খাতে। এই প্রেক্ষাপটে নিজেদের এআই গবেষণা কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে আরও বড় অংকের বিনিয়োগ উত্তোলনের পথে হাঁটে তাঁরা।
ফলে একসময়ের অ-লাভজনক প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই আরও বড় অংকের বিনিয়োগ উত্তোলনের জন্য লাভজনক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো গ্রহণ করতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই ২০১৫ সালের ‘ওপেন-সোর্স অঙ্গীকার’ থেকে সরে এসে এবার তাঁরা নিজেদের এআই গবেষণাকে মালিকানাধীন রাখতে শুরু করে। ওপেনএআই’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ইলন মাস্ক তাই সাম্প্রতিক সময়ে সিইও স্যাম অল্টম্যানের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগ এনেছেন।
অবশ্য ওপেন-সোর্সের পথে না হাঁটার পেছনে দুটি কারণ দেখিয়েছে ওপেনএআই। এআই’র বাজারে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার চাপের পাশাপাশি পাবলিক ডোমেইনে এআই গবেষণার বিস্তারিত উন্মুক্ত করার ফলে সুরক্ষা ঝুঁকির সম্ভাবনার কথা বলেছে তাঁরা।
তবে ডিপসিকের ওপেন-সোর্স এআই মডেল আসার পর ওপেনএআই’র মতো শীর্ষ এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষ করে অন্যান্য এআই মডেলগুলোর তুলনায় ডিপসিক এআই’র নির্মাণ ও ব্যবহার খরচ এতোটাই কম যে, এআই বিশ্বের প্রচলিত ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছে চীনের এই এআই ল্যাবটি।
খরচের পাশাপাশি ডিপসিক ওপেন-সোর্স হওয়ায় প্রচলিত এআই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বাধ্য হচ্ছে ওপেন-সোর্স বা উন্মুক্ত-সোর্স নিয়ে ভাবতে। কেননা সাধারণ ব্যবহারকারীরা একবার ডিপসিক এআই অ্যাসিসট্যান্ট ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে এবং তাঁদের ওপেন-সোর্স মডেলগুলো দিয়ে তৈরি বিভিন্ন এন্টারপ্রাইজ এআই টুল জনপ্রিয় হলে ডিপসিক-কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতে পারে বিশাল এক ইউজার-বেজ, যেমনটার অ্যান্ড্রয়েডের ক্ষেত্রে হয়েছে।
ওপেনএআই, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন ও আলিবারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চয়ই চাইবে না এমনটা হোক। বিশেষ করে চীনের তৈরি একটি এআই চ্যাটবট ও মডেলে ইউরোপ-আমেরিকার ব্যবহারকারীরা অভ্যস্ত না হোক এমনটাই চাইবে আমেরিকার এআই প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, খরচের কথা ভেবে অনেক ডেভেলপারই এখন বিভিন্ন এআই টুল তৈরিতে ডিপসিকের উন্মুক্ত এআই মডেলগুলোকে প্রাধান্য দিতে পারেন।
ওপেনএআই তাঁদের সবগুলো কিংবা কয়েকটি মডেলকে ডেভেলপারদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেও চ্যাটজিপিটি’র প্রিমিয়াম ভার্সনের সাবসক্রিপশন বিক্রি করার মাধ্যমে আয়ের পথ তাঁদের খোলাই থাকবে। চ্যাটজিপিটি বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় এআই চ্যাটবট। ফলে কয়েকটি মডেল উন্মুক্ত করে দিলেও তাঁদের হারানোর কিছু থাকবে না, বরং এআই খাতে নিজেদের নেতৃস্থানীয় অবস্থানকে আরও জোরালো করতে সক্ষম হবে প্রতিষ্ঠানটি।
উল্লেখ্য, ওপেনএআই নতুন করে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ উত্তোলন করতে চাইছে যেখানে তাঁদের বাজারমূল্য ধার্য করা হতে পারে রেকর্ড ৩০০ বিলিয়ন ডলার। এর আগে গত অক্টোবরে ১৫৭ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যে ৬.৬ বিলিয়ন ডলার উত্তোলন করে ওপেনএআই।
আরও পড়ুন: