বুধবার

২ এপ্রিল, ২০২৫
১৮ চৈত্র, ১৪৩১
৪ শাওয়াল, ১৪৪৬

মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংঘর্ষের আশঙ্কা, যা জানালেন গবেষকরা

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২ মার্চ, ২০২৫ ২১:৫৪

শেয়ার

মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংঘর্ষের আশঙ্কা, যা জানালেন গবেষকরা
মহাকাশে দুটি স্যাটেলাইটের সংঘর্ষের এআই জেনারেটেড প্রতীকী ছবি। ছবিসূত্র: ফ্রিপিক

গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা, আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জলবায়ুতে। এবারে এক গবেষণায় জানা গেল, গ্রিনহাউজগ্যাসের কারণে এক সময় মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যা কমে যেতে পারে! ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-এর পরিচালিত এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ এই তথ্য।

থার্মোস্ফেয়ার বা তাপমণ্ডল হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চতুর্থ স্তর, যেটি শুরু হয় পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৮৫ কিলোমিটার ওপরে এবং প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এর ব্যাপ্তী। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) ও অসংখ্য স্যাটেলাইটের অবস্থান এই তাপমণ্ডলেই। মহাকাশ গবেষণায় তাই তাপমণ্ডলের গুরুত্ব অপরিসীম।

এমআইটি’র গবেষণা বলছে, কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো বিভিন্ন গ্রিনহাউজগ্যাসের কারণে সংকুচিত হবে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর, বিশেষ করে থার্মোস্ফেয়ার বা তাপমণ্ডল। এই সংকোচনের ফলে বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব হ্রাস পাবে, অর্থাৎ তাপমণ্ডলে এয়ার মলিকিউল বা বায়ুর অণুর সংখ্যা কমে যাবে। এতে করে স্যাটেলাইট ও বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষের (স্পেস জাঙ্কের) ওপর থেকে বায়ুমণ্ডলীয় টান বা বাধা (ড্র্যাগ) হ্রাস পাবে। আর এমনটা হলে মহাকাশে স্যাটেলাইট ও বিভিন্ন বস্তুর ধ্বংসাবশেষ আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে- যার ফলে একে-অন্যের সাথে সংঘর্ষের ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে। 

আর তাই গবেষকরা মনে করছেন সংঘর্ষ এড়াতে এক সময় মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যা কমিয়ে আনতে বাধ্য হবে মহাকাশ সংস্থাগুলো। কেননা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চেয়েও তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে বিদ্যমান স্যাটেলাইটগুলোকে নিরাপদে অপারেট করার বিষয়টি। 

সহজ করে বললে, পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত স্যাটেলাইট ও বিভিন্ন বস্তুর ধ্বংসাবশেষগুলো সব সময়ই এক প্রকার বায়ুমণ্ডলীয় টান বা বাধার (অ্যাটমস্ফেরিক ড্র্যাগ) সম্মুখীন হয়ে থাকে। এর ফলে এগুলো পর্যায়ক্রমে নিচে নামতে থাকে এবং এক সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশ করে। 

কিন্তু যেমনটা গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, গ্রিনহাউজগ্যাসের কারণে বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব হ্রাস পাবে এবং তাপমণ্ডলে এয়ার মলিকিউল বা বায়ুর অণুর সংখ্যা কমে যাবে। ফলে স্যাটেলাইট ও বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষের সাথে এয়ার মলিকিউল বা বায়ুর অণুর সংঘর্ষও কম হবে। আর ঠিক এ কারণেই বায়ুমণ্ডলীয় টান বা বাধার (অ্যাটমস্ফেরিক ড্র্যাগ) পরিমাণও হ্রাস পাবে। টান কম থাকায় স্যাটেলাইট ও অন্যান্য বস্তুগুলো তুলনামূলক কম গতিতে নিচে নামবে, ফলে কক্ষপথে তাদের অবস্থান আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। এমন পরিস্থিতিতে পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন বস্তুর ভিড় যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে তা তো বলাই বাহুল্য। 

বিজ্ঞানবিষয়ক পিয়ার-রিভিউড মাসিক জার্নাল নেচার সাসটেইনেবিলিটি’তে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এমআইটি’র গবেষণাপত্রটি। গবেষণাপত্র অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত পরিবেশের ওপর বিভিন্ন মাত্রার কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের প্রভাব পর্যালোচনার জন্য গবেষকরা কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করেছেন। 

এরুপ কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে তাঁরা অনুমান করছেন যে, গ্রিনহাউজগ্যাসের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের ২০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে স্যাটেলাইট বহনের ক্ষমতা (ক্যারিয়িং ক্যাপাসিটি) বর্তমানের তুলনায় ৫০ থেকে ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। আর এমনটা ২১০০ সালের মধ্যে হবে বলেই ধারণা করছেন গবেষকরা। 

অর্থাৎ, একবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ গ্রিনহাউজগ্যাসের কারণে বায়ুমণ্ডলীয় টান বা বাধা (অ্যাটমস্ফেরিক ড্র্যাগ) হ্রাস পাওয়ায় পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইট ও বিভিন্ন বস্তুর ধ্বংসাবশেষ বহন বা ক্যারি করার সক্ষমতা অর্ধেকেরও বেশি কমে যেতে পারে। এর ফলে স্যাটেলাইট ও বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাবে এবং এই অঞ্চলে স্যাটেলাইট পরিচালনা অনিরাপদ হয়ে পড়বে। 

এমআইটি’র সহযোগী অধ্যাপক রিচার্ড লিনারেস মনে করেন যে, বিগত সময়ের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রভাবে আগামী শতাব্দীতে স্যাটেলাইট কার্যক্রম ব্যাপক আকারে বাধাগ্রস্ত হবে। বিশ্বব্যাপী স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমস্যা আরও তীব্র হয়ে উঠবে।

গবেষণার প্রধান লেখক উইলিয়াম পার্কার তাই স্যাটেলাইট কার্যক্রম পরিচালনায় সাবধানতা অবলম্বনের পাশাপাশি নিম্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইট ও ধ্বংসাবশেষের ভিড় রোধে গ্রিনহাউজগ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। গবেষণাপত্রে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন ও কক্ষপথে অতিরিক্ত ধ্বংসাবশেষ জমা হওয়ার সমস্যা থেকে উত্তরণে সম্মিলিত প্রচেষ্টা অতীব প্রয়োজন।

নিম্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইটের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, ততই বাড়বে সংঘর্ষের ঝুঁকিও। এর ফলে কেসলার সিনড্রোম নামে পরিচিত ধ্বংসাবশেষের ক্যাসকেড হওয়ারও জোরাল সম্ভাবনা তৈরি হবে। গবেষকরা জোর দিয়ে বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইট কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এবং বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে গ্রিনহাউজগ্যাস নিঃসরণের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে জানতে হবে। আর সে কারণেই এই ধরণের গবেষণা কার্যক্রম অতীব জরুরী বলে মনে করছেন তাঁরা।

 

 

banner close
banner close