যুক্তরাষ্ট্রে সবসময় মাত্র দুটি রাজনৈতিক দলের আধিপত্য বিরাজ করে। হাতি প্রতীক নিয়ে রিপাবলিকান পার্টি আর ডেমোক্র্যাট পার্টি লড়বে গাধা প্রতীকে। প্রতিবার এই দুই দলের কোনো একটির প্রার্থীই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
ডেমোক্র্যাট পার্টি উদার রাজনৈতিক দল বলে পরিচিত। তাদের এবারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস। অন্যদিকে, রিপাবলিকান পার্টি একটি রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। এবার এ দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র একদিন বাকি। মার্কিন ভোটাররা মঙ্গলবার ভোট দেবেন। তবে নির্বাচনে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই যে জয়ী হবেন; এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন না। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ নামের এক পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
ইলেক্টোরাল কলেজ কী?
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস অথবা রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। তবে এদের দুজনের মধ্যে কে জয়ী হবেন, সেটা ভোটারদের দেয়া ভোটে সরাসরি নির্ধারিত হবে না। জাতীয় স্তরের নির্বাচনি লড়াইয়ের বদলে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনি লড়াইয়ের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকটি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পেয়ে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্রে মোট ইলেক্টোরাল কলেজের সংখ্যা ৫৩৮। মাইন ও নেব্রাসকা এই দুইটি অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি সবগুলো রাজ্যের ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট যোগ দিলে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ভোট পাবেন তিনিই শেষপর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।
যেভাবে কাজ করে ইলেক্টোরাল কলেজ?
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি করে ইলেক্টোরাল ভোট থাকে, যা ওই অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার মোটামুটিভাবে সমানুপাতিক হয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে আছে সর্বাধিক ৫৪টি এবং ভায়োমিং, আলাস্কা ও নর্থ ডাকোটার (ওয়াশিংটন ডিসি) মতো যেসব অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা খুবই কম, তাদের আছে ৩টি ইলেক্টোরাল ভোট।
ধরা যাক, টেক্সাসে একজন প্রার্থী ভোটারদের সরাসরি ভোটের ৫০.১% পেয়েছেন, তখন ওই অঙ্গরাজ্যের ৪০টি ইলেক্টোরাল ভোটের সবগুলো সেই প্রার্থী পেয়ে যাবেন। একটি অঙ্গরাজ্যে জয়ের ব্যবধান যদি বিরাট হয়ও, তাহলেও জয়ী প্রার্থী অতগুলি ইলেক্টোরাল ভোটই পাবেন।
দেশব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েও কি কেউ পরাজিত হতে পারেন?
একজন প্রার্থী সারা দেশে হয়ত কম ভোট পেয়েছেন, কিন্তু বেশ কতগুলো কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়ে একজন প্রেসিডেন্ট হয়ে যেতে পারেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ কম ভোট পেয়েও তাকে পরাজিত করেছিলেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০০ সালে আল গোরকে পরাজিত করেছিলেন, যদিও সাধারণ ভোটে গোর ৫ লক্ষেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।
একেক রাজ্যের হাতে একেক সংখ্যক ভোট থাকার কারণে প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচার এমনভাবে পরিকল্পনা করেন যাতে করে বেশি ভোট আছে এমন রাজ্যগুলো প্রাধান্য পায়।
ইলেক্টোরাল কলেজ কেন বলা হয়?
‘কলেজ’ শব্দটির অর্থ এখানে সেই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যারা একটি অঙ্গরাজ্যের ভোট দেয়ার অধিকারী। ইলেক্টোরাল কলেজ’ হচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল, যাদের ‘ইলেকটরস’ বলা হয়। এরা আসলে নির্বাচকমণ্ডলী। প্রতি ৪ বছর পর পর এটি গঠন করা হয় এবং এরাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে বাছাই করেন।
কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে প্রতিটি স্টেটের ইলেকটরসের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। আবার নির্ধারিত হয় স্টেটে সেনেটরের সংখ্যা (প্রত্যেক স্টেটে ২ জন) এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধির (যা জনসংখ্যার অনুপাতে) যোগফল মিলিয়ে।
এই প্রথা শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্যই ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় সরাসরি মানুষের ভোটেই।
যে প্রার্থী অঙ্গরাজ্যে জয়ী হবেন, তাকেই কী ভোট দিতে বাধ্য নির্বাচকরা?
কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নির্বাচকদের এমন স্বাধীনতা আছে, তারা সাধারণ ভোটাররা কাকে পছন্দ করেছেন, তার ওপরে নির্ভর না করে নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। তবে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছেন যে প্রার্থী, তাকেই নির্বাচকরা ভোট দিয়েছেন।
অঙ্গরাজ্য থেকে যাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে যদি কোনো নির্বাচক ভোট দেন, তাকে ‘ফেইথলেস’ বা অবিশ্বাসী বলা হয়। কিছু অঙ্গরাজ্যে ‘ফেইথলেস’ নির্বাচকদের জরিমানা করা বা মামলা দেয়া হয়ে থাকে।
এর আগে ২০১৬ সালের নির্বাচনে এভাবেই ৭টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট দেয়া হয়েছিল, তবে নির্বাচনের ফলাফলে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।
ইলেক্টোরাল ভোট সমান হলে কী হবে?
যদি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউ না পান, সেক্ষেত্রে মার্কিন আইন সভার নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। মাত্র একবারই এটি হয়েছে ১৮২৪ সালে। ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট ৪ জন প্রার্থীর মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি।
বর্তমানে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দুটির যে আধিপত্য রয়েছে, তাতে ওইরকম ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
কেন ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি?
যখন ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লেখা হয়, তখন বিশাল দেশটিতে যোগাযোগের অভাবে জাতীয় স্তরে সাধারণ মানুষের ভোট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা কার্যত অসম্ভব ছিল। সেই সমস্যা সমাধানে সংবিধান রচয়িতারা ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
সংবিধান প্রণেতারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান রচনার সময় কংগ্রেস এবং জনগণের সরাসরি ভোটে (পপুলার ভোট) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই পদ্ধতি বাতিল করে দেন। তাদের যুক্তি ছিল পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মানুষ তাদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে এবং তার ফলে বড় রাজ্যগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে।
ছোট ছোট রাজ্যগুলো এই ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিকে সমর্থন করে কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই পদ্ধতির পক্ষ নেয় কারণ সেসময় এসব রাজ্যে দাসের সংখ্যা ছিল অনেক। দাসদের ভোটাধিকার না থাকা সত্ত্বেও আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হতো।
এছাড়াও সংবিধান রচয়িতারা চাননি যে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে শুধু আইন প্রণেতারা দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করুক।
লাল রাজ্য ও নীল রাজ্য
আমেরিকান নির্বাচনে রিপাবলিকান দুর্গ বলে পরিচিত কিছু অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় ‘রেড স্টেট’ বা ‘লাল রাজ্য’ আর ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য পাওয়া স্টেটগুলোকে বলা হয় ‘ব্লু স্টেট’ বা ‘নীল রাজ্য’। ফলে এসব রাজ্য নিয়ে প্রার্থীদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না।
কিন্তু হাতে গোনা কিছু অঙ্গরাজ্য আছে যে রাজ্যগুলোর ভোট, প্রার্থীদের কারণে যেকোনো পক্ষে যেতে পারে। ফলে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা নির্দিষ্ট কিছু ‘সুইং স্টেট’-এর দিকে নজর দেন যেখানে ভোট কোন পার্টির পক্ষে যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বোঝা যায় না।
এ রাজ্যগুলো আমেরিকান নির্বাচনের ব্যাটলগ্রাউন্ড। এগুলোকেই ‘বেগুনি রাজ্য’ বলে থাকে অনেকে। প্রার্থীদের কাছে এসব অঙ্গরাজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় জয়-পরাজয়ের মূল চাবিকাঠি। এই রাজ্যগুলোতেই হয় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাডা, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যগুলি ২০১৬ সালে এভাবেই ‘ব্যাটল-গ্রাউন্ড স্টেট’ হয়ে উঠেছিল।
প্রত্যেক নির্বাচনের সময় দেখা গেছে যেসব রাজ্যের ভোট বেশি, প্রার্থীরা সেসব রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারের পেছনে অনেক বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করে থাকেন।
ভুয়া নির্বাচক?
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা ‘ভুয়া নির্বাচক’ শব্দটির সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হন। সে বছর ট্রাম্পপন্থী রিপাবলিকানরা ৭টি অঙ্গরাজ্যে নিজেদের নির্বাচক তৈরি করেছিলেন যাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘুরিয়ে দেয়া যায়। তারা ভুয়া নথি বানিয়ে, তাতে সই করিয়ে ১৪ ডিসেম্বর অঙ্গরাজ্যের রাজধানীতে যান।
ওইদিনই গোটা দেশের নির্বাচকরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট দিয়েছিলেন। এই জালিয়াতিতে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্ত এখনও চলছে।
কিছু উল্লেখযোগ্য নির্বাচনের ফলাফল
২০১৬: রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েছিলেন।
২০০০: রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডাব্লিউ বুশ ২৭১টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অ্যাল গোর ৫ লাখ ৪০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
১৮৮৮: রিপাবলিকান প্রার্থী বেঞ্জামিন হ্যারিসন ২৩৩টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড এক লাখ ৪৫৬ ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
১৮৭৬: রিপাবলিকান রাদারফোর্ড বি হেইজ ১৮৫টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী স্যামুয়েল জে টিলডেন দুই লাখ ৬৪ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
১৮২৪: ইলেকটোরাল কলেজ ৪ জন প্রার্থীর পক্ষে বিভক্ত হয়ে হাউজ জন কুইন্সি অ্যাডামসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, যদিও এন্ড্রু জ্যাকসন তার চেয়েও বেশি পপুলার ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: