
সুদানের গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়া লাখো মানুষের জন্য স্থাপন করা একটি আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ হামলা টানা তৃতীয় দিনের মতো চলছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে বিবিসি রবিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।প্রতিবেদন অনুসারে, জমজম শিবিরে থাকা একজন পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন ‘চরমভাবে বিপর্যয়কর’ হিসেবে। আরেকজন বলেছেন পরিস্থিতি ‘মারাত্মক’।
অন্যদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত সপ্তাহের শেষ দিকে শুরু হওয়া একের পর এক হামলায় এখন পর্যন্ত শতাধিক বেসামরিক নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত ২০ শিশু ও একটি চিকিৎসাদলও রয়েছে। হামলাগুলো চালানো হয়েছে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশের শহর ও তার আশপাশের দুই শিবিরে।
এই হামলার জন্য দায়ী করা হয়েছে দেশটির আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ)। তবে তারা দাবি করেছে, নিরীহ মানুষের ওপর তারা হামলা চালায়নি এবং হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যগুলো বানানো।
বিবিসি বলছে, জমজম ও আবু শৌক নামের শিবির দুটি সাত লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষের অস্থায়ী আবাস, যাদের অনেকেই দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি। আরএসএফ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে এই হামলার খবর এলো।
জাতিসংঘের সুদানের মানবিক সমন্বয়কারী ক্লেমেন্টাইন নকুয়েতা-সালামি জানিয়েছেন, তিনি ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত’। তিনি বলেন, ‘বাস্তুহারা মানুষ ও সাহায্যকর্মীদের ওপর বর্বর হামলার ধারাবাহিকতায় এটি একটি ভয়াবহ ও অগ্রহণযোগ্য মাত্রা।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও বলেছে, তারা জমজম ও আবু শৌকে আরএসএফের হামলার খবরে ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ এবং ‘সবচেয়ে অসহায় মানুষদের ওপর হামলার’ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। অন্যদিকে মঙ্গলবার সুদানবিষয়ক একটি সম্মেলন আয়োজন করা ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এ হামলাকে ‘চমকে দেওয়ার মতো’ বলেছেন এবং আরএসএফের ‘নির্বিচারে হামলা’র নিন্দা জানিয়েছেন।
এ ছাড়া সাহায্য সংস্থা রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, জমজমে চিকিৎসক, রেফারাল ড্রাইভার, টিম লিডারসহ তাদের ৯ জন কর্মী ‘নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন’। তাদের দাবি, ‘এটি পরিকল্পিত হামলা, যার উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলের চিকিৎসা অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া, যাতে গৃহহারা মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। আমাদের একটি ক্লিনিকও হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে, সঙ্গে এল-ফাশারের অন্যান্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রও।আরএসএফ শনিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তারা বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা চালায়নি এবং জমজমে যা ঘটেছে, তা তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য সাজানো।
‘বিপুলসংখ্যক তরুণ নিহত হয়েছে’
হোয়াটসঅ্যাপের একটি অডিও বার্তায় রবিবার সকালে মোস্তফা নামের (৩৪) এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, তিনি জমজমে একটি কমিউনিটি কিচেনে কাজ করতেন এবং সেখানে ‘বিপুলসংখ্যক তরুণ নিহত হয়েছে’।
তিনি আরো বলেন, ‘কমিউনিটি কিচেনে যারা কাজ করতেন, তারা মারা গেছেন। হাসপাতাল ফের চালু করার যে উদ্যোগ ছিল, সেই প্রকল্পে যুক্ত চিকিৎসকরাও নিহত হয়েছেন। আমার চাচা আর চাচাতো ভাই নিহত হয়েছেন। অনেকে রক্তক্ষরণে মারা যাচ্ছে। কারণ এখানে ওষুধ নেই, হাসপাতাল নেই।’তিনি আরো জানান, শিবিরের চারদিকে সব পথ বন্ধ এবং চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে।
আরেক বাসিন্দা ওয়াসির বলেন, ‘জমজমে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অনেক বেসামরিক লোক পালিয়ে গেছে, আমরাও পালানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। সব রাস্তা বন্ধ, সঙ্গে ছোট ছোট বাচ্চাও আছে। চারদিকে মৃত্যু। আমি এখন যেখান থেকে কথা বলছি, সেটা একটি খন্দক, আর এখানেও গোলাবর্ষণ চলছে।’
স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিশেষজ্ঞ শুক্রবার জানিয়েছেন, ‘এটি ২০২৪ সালের বসন্তে এল-ফাশারে সংঘাত শুরুর পর থেকে জমজমে সবচেয়ে ভয়াবহ স্থল হামলা।’ইয়েল স্কুল অব পাবলিক হেলথের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব জানায়, ‘শিবিরের কেন্দ্র, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বহু কাঠামো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা দগ্ধ হয়েছে।’
২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকেই এই যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধই তৈরি করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট, বাস্তুচ্যুত করেছে এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষকে এবং বহু অঞ্চলকে ঠেলে দিয়েছে ক্ষুধার মুখে। দারফুরের এল-ফাশার শহরটি এখনো সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা শেষ প্রধান শহর এবং আরএসএফ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি ঘিরে রেখেছে।
আরও পড়ুন: